দুপুর – ১২টা জীবনে কখনো এমন সময় আসে যখন আপনার মাথার উপর ছাদ থাকবে। আবার কখনো সেই ছাদ সরে যাবে। ঠিক কী কারণে আমি ঘরছাড়া হলাম তা বলবো না কারণ এটা একটা গোপন ব্যাপার আমার কাছে আর ইন্ডিয়ানদেরকে (এখানে ইন্ডিয়ান মানে উত্তর আমেরিকার আদিবাসী, ভারতীয় নয়) পাগলা সাদা চামড়াগুলোর কাছ থেকে নিজেদের গোপনীয়তা লুকিয়ে রাখতে যথেষ্টই ঝামেলা পোহাতে হয়। আমি স্পোকেইন (Spokane) ইন্ডিয়ান, স্যালিশ ভাষার লোক। আমার পূর্বপুরুষ এখানে, এই ওয়াশিংটনের স্পোকেইনের ১০০ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে বাস করে করে আসছে ১০ হাজার বছর ধরে। আমি স্পোকেইনেই বড় হয়েছি। পরে কলেজে পড়তে সিয়াটলে গেছি প্রায় তেইশ বছর আগে। দুই সেমিস্টার পরই কলেজ ছেড়েছি। তারপর থেকে ভাল-খারাপ মিলিয়ে অনেক রকমের কাজ করেছি, বিয়ে করেছি বার দুই-তিনেক, দু-তিনটে বাচ্চা হয়েছে। আর তারপর-ই মাথাটা খারাপ হয়ে গেলো। সত্যি বলতে কি, মাথা খারাপ বলতে যা বোঝায়, আমার সমস্যাটা তেমন কিছু না। ভাবতে পারেন, আমি বুঝি সিরিয়াল কিলার টাইপ কিছু। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি ওরকম কিছুই না। আমি জীবনে কাউকে ব্যথা দেইনি-অন্তত শারীরিক ভাবে তো নয়। কারো কারো হৃদয়ে ব্যথা দিয়েছি অবশ্য, তা কে না দেয়! এ ক্ষেত্রে আমার বিশেষত্ব বলতে কিছু নেই। কারো হৃদয়ে আমি হুট করে আঘাত দেইনি। ধীরে-সুস্থে সময় নিয়েছি। এবং হুট-হাট বাসা ছেড়ে পালাইনি আমি। যখন পালিয়েছি , আর ফিরে যাইনি। ছয় বছর হয়ে গেল আমি বাড়িছাড়া। এর ভাল দিকটাও বোধহয় আমি ছাড়া আর কেউ এত ভাল ধরতে পারেনি। এই একটা দিক-ই আছে আমার অন্তত যেদিকটায় আমি সুবিধা করতে পেরেছি। আমি জানি সবচেয়ে ভাল খাবারটা কোথায় পাওয়া যায়। আমি কিছু রেস্টুরেন্ট এবং স্টোর ম্যানেজারদের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে নিয়েছি। ফলস্বরূপ তারা আমাকে এমনকি তাদের বাথরুম পর্যন্ত ব্যবহার করতে দেয়। এই বাথরুম কিন্তু পাবলিক বাথরুম না। তাদের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য বানানো পরিষ্কার বাথরুম, যেটা বেশিরভাগ সময়ে কিচেন কিংবা প্যান্ট্রি অথবা কুলারের পিছনে আড়াল করা থাকে। জানি হাস্যকর শোনায়, তবু অন্যের ব্যক্তিগত পরিষ্কার বাথরুমে প্রস্রাব করার মতো বিশ্বাস অর্জন করতে পারাটা আমার কাছে মনে হয় বিশাল কিছু। আপনারা হয়তো পরিষ্কার বাথরুমের মর্ম বুঝবেন না, কিন্তু আমি বুঝি। জানি এসব শুনে আপনি মজা পাবেন না। সিয়াটলের সব জায়গায় আপনি উদ্বাস্তু ইন্ডিয়ানদের দেখা পাবেন। আমরা সবাই প্রায় একইরকম। একইরকম বোরিং। আপনি আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাবেন। কখনো রাগ, কখনো বিরক্তি কিংবা কখনো করুণা নিয়ে তাকাবেন আমাদের দিকে। তবে আমাদেরও পরিবার আছে, আছে স্বপ্ন। আমার এক ইন্ডিয়ান বন্ধু আছে । সেও উদ্বাস্তু। দাবি করে তার ছেলে পশ্চিমের কোনো এক বড় পত্রিকার সম্পাদক। গাঁজাখুরিও হতে পারে কেননা আমরা, প্রায় সব ইন্ডিয়ানরাই, মিথ্যা বলতে আর গল্প ফাঁদতে ওস্তাদ। কে জানে, ওই ব্যাটা আর দশজন ইন্ডিয়ানের মতই সাধারণ একজন প্লেইন্স ইন্ডিয়ান (কানাডার প্রেইরী ও সমভূমিতে বাস করে এরা) এখানে-ওখানে কাজ খুঁজে বেড়ায় কিনা। তাকে নিয়ে আমার সন্দেহ হয় কারণ নিজের পরিচয় বলতে সে বলে সে একজন প্লেইন্স ইন্ডিয়ান, কিন্তু নির্দিষ্ট কোন গোত্রের কথা বলে না। জিজ্ঞেস করলে বড়জোর বলবে, “আমরা কেউ কি জানি যে আমাদের আসল পরিচয় কী?” বড় দার্শনিক আমার! আমি বলি, “তোমার বাড়িঘর তো কিছু একটা থাকতে হবে, তাই না? ” সে কিছু না বলে হেসে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ানোর সময়ে আমার সাথে কয়েকজন থাকে; এরা আমার দলের সদস্য, আমার প্রতিরক্ষা বাহিনী, আমার বডিগার্ড। এই দলে আছে শ্যারন (মূল গল্পে Rose of Sharon লেখা হয়েছিলো, আমি শুধু শ্যারন লিখছি), জুনিয়র, এবং আমি। আর কারো সাথে বনিবনা না হলেও আমরা একসাথে থাকি। শ্যারন এক বিশাল মহিলা। সামগ্রিক প্রভাব বিবেচনায় তার উচ্চতা ৭ ফিট। আর শারীরিক উচ্চতা ৫ ফিট। তার পরিচয় – সে উইস্রাম ভ্যারাইটির ইয়ামাকা ইন্ডিয়ান। জুনিয়র কোলভিলের। তবে কোলভিলের ১৯৯টা গোত্র আছে। সে যে কোনোটা একটার হতে পারে। জুনিয়র দেখতে-শুনতে ভালই। দেখলে মনে হবে ‘পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচী’-র বিজ্ঞাপন করে বের হয়ে এসেছে। তার গালের হাড় দেখলে মনে হয় গ্রহ-নক্ষত্রের চিত্র আঁকা। ওকে দেখে আমার হিংসা হয়, হিংসা আর হিংসা। আমার পাশে জুনিয়রকে দাঁড় করালে মনে হবে ও কলম্বাস পূর্ব যুগের ইন্ডিয়ান আর আমি কলম্বাস পরবর্তী যুগের। সাম্রাজ্যবাদ আমাদের কী ক্ষতি করেছে আমি তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এইসব ইতিহাস মনে পড়লে আমার মাথার ভিতর ভয় জেঁকে বসে। আমি একজন শক্ত-সামর্থ্য মানুষ। আমি জানি সাদা চামড়ার মানুষদের সাথে মিলে-মিশে থাকতে এইসব বিষয়ে কথা না বলাই ভাল। আমার গল্পের শুরুটা দুপুরবেলায়। আমি আর শ্যারন পাইক প্লেস মার্কেটের সামনে একটা হ্যান্ডেল ঘুরাচ্ছিলাম। দুই ঘণ্টা বাদানুবাদের পর শেষ পর্যন্ত আমাদের কপালে জুটল পাঁচ ডলার। সেভেন-ইলেভেন থেকে এক বোতল ফর্টিফাইড কারেজ কেনা যায় তাতে। আমরা সেদিকেই রওনা দিলাম। চলতে চলতে একটা সুদ কারবারির দোকানকে পাশ কাটিয়ে আসলাম। এই দোকানটা আগে কখনো চোখে পড়েনি। অদ্ভুত-ই বলতে হবে কারণ আমাদের সব ইন্ডিয়ানদের মধ্যেই সুদ কারবারির দোকান চিনতে পারার এক আশ্চর্য ক্ষমতা থাকে। সবচেয়ে বিস্ময়কর যে জিনিসটা চোখে পড়ল সেটা হলো: একটা পুরনো আদিবাসী পাও-ওয়াও নৃত্যের রেগালিয়া (আদিবাসী নৃত্যের বিশেষ পোশাক)। জানালাতে সেটা ঝুলানো ছিলো। “এটা আমার দাদীর রেগালিয়া,” শ্যারন আর জুনিয়রকে বললাম। “তুমি নিশ্চিত?” জুনিয়র জানতে চাইলো। আমি আসলে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম না। তার কারণ- এই জিনিসটা সরাসরি চোখে দেখিনি কখনো। শুধু ছবিতে দেখেছি এটা নিয়ে দাদীকে নৃত্যরত অবস্থায়। একদিন সেটা চুরি হয়ে যায়। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের ঘটনা! কিন্তু আমার স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে, তবে এটাই সেই রেগালিয়া। সেলাই করা রঙিন পালক আর গুটি গুলো দেখতে একইরকম। “একটাই উপায় আছে জানার” আমি বললাম। অতঃপর আমি, শ্যারন, আর জুনিয়র দোকানে ঢুকে পড়লাম। কাউন্টারে পিছনে বসে থাকা বৃদ্ধ শ্বেতাঙ্গ লোকটি আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। “কিভাবে সাহায্য করতে পারি?” তিনি জিজ্ঞেস করলেন। “আপনার জানালায় ঝুলানো ওই রেগালিয়াটা আমার দাদীর। ” বললাম আমি। “পঞ্চাশ বছর আগে এটা চুরি হয়ে যায়। আমার পরিবার তখন থেকে এটা খুঁজে বেড়াচ্ছে।” লোকটা আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন আমি একটা মিথ্যুক। স্বাভাবিক। এখানে যারা আসে সবাই এই ধরনেরই হয়। “আমি মিথ্যা বলছি না।“ বললাম আমি। “আমার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করুন। তারা বলবে।“ “ও আমার দেখা সবচাইতে সৎ ইন্ডিয়ান”, শ্যারন বলল। “ঠিক আছে, সৎ ইন্ডিয়ান”, লোকটা বলল, “তোমাকে প্রমাণের একটা সুযোগ দেওয়াই যায়। তুমি কি প্রমাণ করতে পারবে এইটা তোমার দাদীর?” একমাত্র স্রষ্টা ছাড়া আর কিছুই নিখুঁত নয়। তাই ইন্ডিয়ানরা রেগালিয়া বানানোর সময়ে তাতে খুঁত রেখে দেয়। আমার পরিবার যেমন রেগালিয়ার উপর কোনো এক জায়গায় একটা হলুদ গুটি সেলাই করে রাখতো। কিন্তু এমন জায়গায় আর এমন ভাবে এটা করা হতো যাতে খুঁজে বের করাটা খুব সহজ না হয়। “এটা আমার দাদীর হয়ে থাকলে অবশ্যই এতে একটা হলুদ গুটি লুকানো আছে”, বললাম আমি। “ঠিক আছে” বলল লোকটা, “তাহলে পরীক্ষা করে দেখা যাক”। সে রেগালিয়াটাকে নামিয়ে আনলো। গ্লাস কাউন্টারের উপর বিছিয়ে রাখল। আমরা খুঁজতে লাগলাম হলুদ গুটি। এবং বগলের কাছাকাছি জায়গাটায় পেয়ে গেলাম। “এইতো তাহলে।” দোকান মালিককে বিস্মিত মনে হলো না। “তোমার কথাই ঠিক। এটা তোমার দাদীর রেগালিয়া।” “পঞ্চাশ বছর ধরে এটা নিখোঁজ ছিলো”, জুনিয়র বলল। “জুনিয়র” আমি ধমক লাগালাম,”আমার ফ্যামিলির গল্প আমাকেই বলতে দে।” “ভুল হয়ে গেছে”, বললো সে, “কিছু মনে করো না, বলো।” “এটা পঞ্চাশ বছর ধরে নিখোঁজ ছিলো”, বললাম আমি। “এটা তার ফ্যামিলির জন্য এক দুঃখজনক ইতিহাস”, শ্যারন বললো, “আপনি এটা ওকে ফিরিয়ে দেবেন না?” “তেমন করতে পারলে তো ভালই হতো”, লোকটা বললো, “কিন্তু উপায় নেই। এই জিনিসের পিছনে আমার এক হাজার ডলার খরচ হয়েছে। আমি কীভাবে এক হাজার ডলার পানিতে ফেলে দেই বলো?” “আমরা পুলিশের কাছে গিয়ে সব বলবো”, শ্যারন বলল। “হেই” আমি বললাম ওকে,”অমন হুমকি দিও না তো।” লোকটা ভাবছিলো কী করা যায়। “আমার মনে হয় তোমরা পুলিশের কাছে যেতে পারো”, সে বললো, “কিন্তু তারা তোমাদের কথার এক বর্ণও বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না।” তার কথা শুনে মনে হলো সেও দুঃখিত। আমাদের এই অবস্থার সুযোগ নিতে তারও খারাপ লাগছে। “তোমার নাম কী?” জানতে চাইল সে। “জ্যাকসন”, বললাম আমি। “আগে পরে কিছু নাই?” “আগেও যা পরেও তা।” “মশকরা করছ নাকি?” “সত্যি বলছি। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন জ্যাকসন জ্যাকসন। আমার ফ্যামিলি নিকনেম জ্যাকসন স্কয়ার্ড। আমার ফ্যামিলি আসলে একটু রসিক।” “ঠিক আছে জ্যাকসন জ্যাকসন”, বলল সে, “তোমার নিশ্চয়ই ১০০০ ডলার নেই, নাকি আছে?” “আমাদের সব মিলিয়ে আছে পাঁচ ডলার,” বললাম আমি। “আহারে!”, সে চিন্তা করছে সম্ভাবনাগুলো নিয়ে। “একটা চুক্তিতে আসা যাক তাহলে। তোমার হাতে চব্বিশ ঘণ্টা সময়। এর মাঝে তুমি ৯৯৯ ডলার নিয়ে এসে আমাকে দেবে। কাল দুপুরের মধ্যে যদি টাকা নিয়ে আসতে পারো তবে তোমার দাদীমার রেগালিয়া ফেরত পাবে। ঠিক আছে?” “আমি রাজি”, বললাম আমি। “ঠিক আছে তাহলে,” বলে চলল লোকটা, “সেটাই কথা রইলো। এবং শুরুটাও আমিই করে দিচ্ছি। এই নাও ২০ ডলার।” সে তার ওয়ালেট ঘেঁটে একটা চকচকে ২০ ডলারের নোট বের করে আমাকে দিল। আমি, শ্যারন আর জুনিয়র বেরিয়ে পড়লাম ৯৭৪ ডলারের সন্ধানে। দুপুর ১ টা আমরা তিনজন ২০ ডলারের নোট আর বাকি ৫ ডলার দিয়ে সেভেন-ইলেভেনে তিন বোতল ইমাজিনেশন কিনলাম। এক দিনে বাকি টাকাটা কীভাবে ম্যানেজ করা যায় চিন্তা করা দরকার। চিন্তা করতে করতেই আলাস্কা ওয়ের পেছনে এক অ্যালিতে তিনজনে মিলে তিন বোতল সাবাড় করলাম এক, দুই, তিন। দুপুর ২ টা যখন জেগে উঠলাম দেখি শ্যারন নেই। পরে জেনেছিলাম, সে হাঁটতে হাঁটতে টপেনিসের দিকে চলে গিয়েছিল। সেখানে তার এক বোন থাকে। নিজের বমিতে মাখামাখি হয়ে পাশেই জুনিয়র শুয়ে আছে। কিংবা বমিটা অন্য কারোরও হতে পারে। কাজেই তাকে রেখেই আমি সমুদ্রে নামলাম। সমুদ্রের নোনা জলের গন্ধ আমার ভাল লাগে। লবণের গন্ধ পুরনো স্মৃতির মত মনে হয়। জাহাজ নোঙ্গর করার জায়গাটায় তিন অ্যালিউট কাজিনদের সাথে দেখা হল। ওরা কাঠের বেঞ্চে বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কথা বলছিলো। সিয়াটলের বেশিরভাগ উদ্বাস্তু ইন্ডিয়ানরা এসেছে আলাস্কা থেকে। সুখের স্বপ্ন নিয়ে অ্যাঙ্করেজ, ব্যারো, কিংবা জুনোর কোন নৌকায় চড়ে বসেছিল ওরা। পকেটভর্তি করে নিয়ে আসা টাকা উড়িয়েছে ফূর্তি করতে গিয়ে। তারপর থেকে অপেক্ষায় আছে আবার কোনো নৌকায় উঠে হিমশীতল উত্তরে চম্পট দেবার। অ্যালিউটদের গা থেকে স্যালমন মাছের গন্ধ ছড়াচ্ছিলো। ওরা বললো যে ওদের নৌকা তীরে না ফেরা পর্যন্ত ওরা এখানেই থাকবে। “কতদিন হলো তোমাদের নৌকা ফেরেনি?” জানতে চাইলাম। “এগারো বছর।” ওদের মধ্যে বড়জন বলল। খানিকক্ষণ ওদের সাথে গল্প করলাম। “আমাকে কিছু টাকা ধার দিতে পারো?” জিজ্ঞেস করলাম। ওরা জানালো, পারবে না । দুপুর ৩টা জুনিয়রের কাছে ফিরে এলাম। বেচারা তখনো ঘুমাচ্ছে। আমি তার মুখের কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে নিয়ে এসে পরীক্ষা করে দেখলাম সে শ্বাস নিচ্ছে কিনা। বেঁচে আছে বটে। ওর নীল জিনসের পকেট হাতড়ে একটা আধ খাওয়া সিগারেট পেলাম। সিগারেট টানতে টানতে আমার দাদীর কথা ভাবতে লাগলাম। ওনার নাম ছিল অ্যাগনেস। আমার যখন চৌদ্দ বছর বয়স, তখন তিনি স্তন ক্যান্সারে মারা যান। আমার বাবার ধারণা, ইউরেনিয়াম খনিতে কাজ করতে গিয়েই ক্যান্সার দানা বেঁধেছিলো তার শরীরে। আমার মা অবশ্য বলতেন, এই রোগের সূচনা সেদিন থেকে, যেদিন রাতের বেলা নাচের অনুষ্ঠান থেকে ফেরার সময়ে তিনি মোটরসাইকেল চাপা পড়ে আহত হন এবং তার পাঁজরের তিনটি হাড় ভেঙ্গে যায়। মা বলতেন, ভাঙ্গা হাড়গুলো ঠিকমত সারেনি। আর কোন ক্ষত ঠিকমতো না সারলেই শরীরে ক্যান্সারের টিউমার দানা বাঁধে। জুনিয়রের পাশে বসে ধোঁয়া, বমি, আর লবণের গন্ধ নাকে আসতে ভাবতে লাগলাম, কে জানে রেগালিয়াটা চুরি হওয়াটাই ক্যান্সারের কারণ ছিলো কিনা। হয়তো ক্যান্সারটা বাসা বেঁধেছিল তার ভাঙ্গা হৃদয়ে, আর সেখান থেকে স্তনে। জানি অদ্ভুত শোনায়, যদি কখনো তিনি ফিরে আসতেন, আমি যে কোনো মূল্যে তার হারানো রেগালিয়াটা তাকে ফিরিয়ে দিতাম। আমার টাকা দরকার, অনেক টাকা। জুনিয়রকে ফেলে রেখে আমি আবার হাঁটতে লাগলাম। এবার গন্তব্য রিয়েল চেঞ্জ অফিস। দুপুর ৪টা রিয়েল চেঞ্জ একটা বহুমুখী সংস্থা। এদের সংবাদ প্রকাশনাও রয়েছে। গরিব এবং উদ্বাস্তুদের এরা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রজেক্টের মাধ্যমে সাহায্য করে এবং দারিদ্রের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলে। এদের উদ্দেশ্য গরিব ও উদ্বাস্তুদের জন্য শিক্ষা, কাজের সুযোগের ব্যবস্থা করা, এবং এদেরকে সংগঠিত করা। আমাদের মতো সমাজের নিম্নস্তরের মানুষদের পক্ষে এরা কথা বলে। এদের উদ্দেশ্য আর কর্মকাণ্ড আমার মুখস্থ, কারণ আমি প্রায়ই রাস্তায় এদের পেপার বেচি। তবে বেচার সময়ে আপনাকে মাতাল হলে চলবে না। আর এই শর্তটা সবসময়ে মানা আমার জন্য বেশ কঠিন। যে কেউ পেপার বেচতে পারে। আপনি ত্রিশ সেন্ট দিয়ে প্রতি কপি কিনে এক ডলারে বেচবেন। লাভটা আপনার পকেটে যাবে। “আমার চৌদ্দশ তিরিশখানা পেপার দরকার।” বড় কর্তাকে বললাম। “পেপারের সংখ্যাটা বেশ অদ্ভুত তো। এবং অনেক বড়।” তিনি বললেন। “আমার দরকার আছে।” বড় কর্তা একটা ক্যালকুলেটর বাগিয়ে হিসেব করলেন। “এতগুলো পেপারের জন্য তোমাকে দিতে হবে চারশো ঊনত্রিশ ডলার।” “আমার যদি অত টাকা থাকতই, তাহলে তো ছাতার পেপার বেচতে আসতাম না।” “কাহিনীটা কী জ্যাকসন টু দ্য পাওয়ার টু? ” মজা করে বললেন তিনি। তিনিই একমাত্র আমাকে এই নামে ডাকেন। মানুষটা বেশ মজার। আমি তাকে আমার দাদীর হারানো রেগালিয়ার কাহিনীটা শোনালাম। বললাম এটার জন্যই আমার টাকাটা দরকার। “আমার মনে হয় বিষয়টা পুলিশকে জানানো উচিত।” তিনি বললেন। “আমি ওসব ঝামেলায় যেতে চাই না,” বললাম, “এটা আমার জন্য একটা প্রতিযোগিতা। আমি যেভাবেই হোক এটায় জিততে চাই।” “বুঝলাম,” বড় কর্তা বললেন, “কিন্তু সত্যি বলতে আমি তোমাকে অতগুলো পেপার দিতাম যদি কাজ হতো। কিন্তু আমাদের কারো পক্ষে একদিন সর্বোচ্চ পেপার বিক্রির রেকর্ড হল মাত্র তিনশ দুটো। ” “তাতে আমার লাভ হবে প্রায় দুশো ডলার,” বললাম আমি। “দুশো এগারো ডলার চল্লিশ সেন্ট”, কর্তা ক্যালকুলেটরে হিসাব করে বললেন। “যথেষ্ট না,” আমি বললাম। “তাছাড়া একদিন সর্বোচ্চ ইনকামের রেকর্ড পাঁচশো পঁচিশ। তার কারণ- কেউ একজন হতভাগা বুড়ো ব্লুকে পাঁচশো ডলার ফাও ধরিয়ে দিয়েছিল। গড়ে প্রতিদিন লাভ আসলে মাত্র ত্রিশ ডলার।” “এভাবে কাজ হবে না।” “জানি।” “আমাকে কিছু টাকা ধার দিন না।” “সেটা আমার পক্ষে সম্ভব না। তোমাকে যদি ধার দিই, তাহলে সবাইকেই ধার দিতে হবে।” “তাহলে আপনি কী করতে পারেন?” “আমি তোমাকে বড়জোর পঞ্চাশটা পেপার মাগনা দিতে পারি। কিন্তু খবরদার কাউকে বলো না।” “ওকে।” নিউজপেপার গুলো জড়ো করে সে আমার হাতে তুলে দিলো। সেগুলো আমি বুকের কাছে ধরে রাখলাম। সে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। এরপর আমি বেরিয়ে এলাম। বিকেল ৫ টা জাহাজের নোঙ্গর ফেলার জায়গাটায় ফিরে এসে আমি ব্যানব্রিজ আইল্যান্ড টার্মিনালের কাছে দাঁড়ালাম এবং ফেরিতে আসা ব্যবসায়ীদের কাছে পেপারগুলো বিক্রির চেষ্টা করতে লাগলাম। এক ঘণ্টায় মোটে পাঁচটা বেচতে পারলাম। বাকিগুলো ময়লা ফেলার বাক্সে ফেলে দিয়ে চলে আসলাম ম্যাকডোনাল্ডসে। চারটা চীজবার্গার অর্ডার দিলাম, এক ডলার করে এগুলো। ধীরেসুস্থে সেগুলো শেষ করলাম। খাওয়া শেষে বাইরে বেরিয়েই বমি করে ফেললাম। খাওয়ার সাথে সাথে বমি হয়ে গেলে মেজাজটা যা লাগে তা বলার মতো না। এলকোহলের কারণে পেটের বারোটা বেজেছে আমার। তারপরও সবসময়ে চেষ্টা করি বেঁচে থাকার মতো যথেষ্ট খাবার যেন অন্তত পেটে থাকে। বিকেল ৬টা পকেটে মাত্র এক ডলার নিয়ে জুনিয়রের কাছে ফিরে এলাম। বেচারা এখনো বেহুঁশ। আমি ওর বুকে কান লাগিয়ে শুনলাম হার্ট বীট পাওয়া যায় কিনা। ছোকরাটা বেঁচে আছে। কাজেই আমি ওর মোজা খুলে ফেললাম। ওর বাম পায়ের মোজায় পেলাম এক ডলার আর ডান পায়ের মোজায় পেলাম পঞ্চাশ সেন্ট। যখন আমার বয়স তের, তখন দাদী আমাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার গল্প শোনাতেন। তিনি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে একটা মিলিটারি হসপিটালের নার্স ছিলেন। দুবছর ধরে তিনি অস্ট্রেলিয়ান আর আমেরিকান সৈন্যদের সেবা-শুশ্রূষা করেছেন। একদিন তার কাছে এক আহত মাওরি সৈন্য এলো। যুদ্ধে তার পা উড়ে গিয়েছিলো। সে দেখতে একেবারে ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ। তার ছিল কোঁকড়ানো কালো চুল। তার চোখদুটোও ছিল কালো এবং উষ্ণ। তার মুখ ভর্তি ছিল উল্কি দিয়ে। “তুমি কি মাওরি?” সে জিজ্ঞেস করেছিল দাদীকে। “না। আমি স্পোকেইন ইন্ডিয়ান। আমেরিকা থেকে এসেছি।” “ওহ হো। আমি তোমার গোত্রের গল্প শুনেছি। কিন্তু এই প্রথম কোনো আমেরিকান ইন্ডিয়ানের দেখা পেলাম আমি। ” “অনেক ইন্ডিয়ান সৈন্য আছে যারা আমেরিকার হয়ে যুদ্ধ করছে,” দাদী বলেছিলেন, ”আমার এক ভাই জার্মানিতে যুদ্ধে আছে। আরেক ভাইকে হারিয়েছি ওকিনাওয়াতে।” “শুনে খারাপ লাগলো। ওকিনাওয়াতে আমিও ছিলাম। ভয়াবহ অবস্থা।” “তোমার পায়ের এই অবস্থা দেখে বেশ খারাপ লাগছে”, দাদী বলেছিলেন। “ব্যাপারটা কেমন মজার না?” “কোন ব্যাপারটা মজার?” “এই যে আমরা কালো মানুষেরা একজন আরেকজনকে মারছি যাতে সাদারা বাঁচতে পারে।” “আমি আসলে এভাবে চিন্তা করে দেখিনি।” “মাঝে মাঝে আমি এভাবে ভাবি। আর অন্যসময়ে ওরা আমাদের যেভাবে ভাবতে বলে সেভাবেই ভাবার চেষ্টা করি। আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাই।” দাদী তাকে মরফিন দিয়েছিলেন। “তুমি কি স্বর্গে বিশ্বাস কর?” সে জিজ্ঞেস করলো। “কোন স্বর্গের কথ বলছো?” “যেই স্বর্গে আমার পা দুটো আমার জন্য অপেক্ষা করছে।” তারা হাসলো। “যখন আমি স্বর্গে যাবো” সে বলছিল, “আমার পা দুটো আমার কাছ থেকে ছুটে পালাবে। ওদেরকে কীভাবে ধরবো বল তো?” “তোমার হাত দুটোকে অনেক মজবুত করতে হবে,” দাদী বলেছিলেন, ”যাতে তুমি হাত ব্যবহার করেই দৌড়াতে পার।” তারা আবার হাসতে লাগলো। জুনিয়রের পাশে বসে দাদীর গল্পগুলো মনে করে আমিও হাসলাম। জুনিয়রের মুখের কাছে হাত দিয়ে দেখলাম সে এখনো শ্বাস নিচ্ছে। কাজেই আমি সর্বসাকুল্যে দুই দলার পঞ্চাশ সেন্ট নিয়ে রওয়ানা দিলাম। এবার গন্তব্য পাইওনিয়ার স্কয়ারের কোরিয়ান মুদির দোকান। সন্ধ্যা ৭ টা কোরিয়ান মুদির দোকান থেকে পঞ্চাশ সেন্ট দিয়ে একটা সিগার আর দুই ডলারে দুইটা স্ক্র্যাচ করার লটারি কিনলাম। সর্বোচ্চ পুরস্কার ৫০০ ডলার। যদি দুটো টিকেট-ই জিতি, তাহলে রেগালিয়াটা কেনার মতো পয়সা জোগাড় হয়ে যাবে। রেজিস্টারে যে মেয়েটা কাজ করে, মেরি, তাকে আমি পছন্দ করি। সে দোকান মালিকের মেয়ে। সারাদিন গান গায় মেয়েটা। “আমি তোমাকে ভালোবাসি।” তাকে টাকাটা দিতে দিতে বললাম। “তুমি সবসময়ে এই কথাটাই বলো,” সে জবাব দিলো। “কারণ আমি সবসময়-ই তোমাকে ভালবাসবো।” “তুমি আচ্ছা রকমের পাগল।” “আমি বুড়ো তো কী হয়েছে? এখনো অনেক রোমান্টিক।” “কিন্তু তুমি মানুষটা আমার জন্য একটু বেশি-ই বুড়ো।” “আমি জানি। কিন্তু তারপরও স্বপ্ন দেখতে তো কোনো মানা নেই।” “ঠিক আছে। তোমার স্বপ্নের অংশ হতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমি তোমার হাত ধরবো যদি তুমি কথা দাও যে তুমি আমাকে চুমু খাবে না। কিংবা সেক্স করবে না। স্বপ্নেও না।” “ঠিক আছে যাও। কথা দিলাম। সেক্স হবে না। শুধু রোমান্স।” “বিদায় জ্যাকসন জ্যাকসন, আমার সোনাপাখি। আবার দেখা হবে।” দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। অক্সিডেন্টাল পার্কের দিকে এগোলাম। একটা বেঞ্চে বসে সিগারটা টানতে লাগলাম। দশ মিনিট লাগলো ওটা শেষ করতে। তারপর প্রথম লটারিটা ঘষলাম। নাহ, কিছু পেলাম না। বলা যায় না, এখনো পাঁচশ ডলার জেতার চান্স আছে, কিন্তু তাতে আমার চলবে না। দশ মিনিট পর আর পারলাম না। অন্য লটারিটাও ঘষলাম এবং পুরস্কার হিসেবে পেলাম একটা ফ্রি টিকেট। মন্দের ভাল যাকে বলে। মেরির সাথে দেখা করার জন্য ফিরে চললাম। “জ্যাকসন জ্যাকসন ,” সে বলল আমাকে দেখে,” তুমি কি এবার আমার হৃদয় চাইতে এসেছো?” “আমি একটা ফ্রি টিকেট জিতেছি।” বললাম। “পুরুষ মানুষ এমন-ই হয়,” সে বলল,” তুমি আমার চাইতে বেশি ভালবাসো টাকা আর ক্ষমতা।” “সত্যিটাই বলেছো,” আমি বললাম,” দুঃখিত কারণ এটা আসলেই সত্য।” সে আমাকে আরেকটা টিকেট দিল। টিকেট নিয়ে বাইরে চলে এলাম। মানুষজনের সামনে টিকেট দেখতে আমার ভাল লাগে না। টিকেটটা ঘষলাম, অনেক আশা আর ভয় নিয়ে। আর এইবার সত্যি সত্যি টাকা পেলাম। মেরির কাছে ফিরে গেলাম। “একশ ডলার জিতেছি।” সে টিকেটটা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলো। তারপর হাসলো। “ভাগ্য বটে তোমার।” বিশ ডলারে পাঁচটা নোট গুণতে গুণতে বলল সে। টাকাটা দেওয়ার সময়ে তার হাতে আমার হাতের স্পর্শ লাগলো। এক মুহূর্তে আমার শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। “ধন্যবাদ,” বলে তাকে একটা নোট ধরিয়ে দিলাম। “আমি এটা নিতে পারবো না,” সে বলল,” এটা তোমার টাকা।” “উঁহু। এটা আমাদের গোত্রের রীতি। তুমি কোনো কিছু জিতলে তা তোমার পরিবারের সাথে শেয়ার করবে।” “আমি তোমার পরিবারের কেউ নই।” “তুমি আমার পরিবার।” সে হাসলো। টাকটা নিলো। পকেটে আশি ডলার নিয়ে, প্রিয়তমা মেরিকে বিদায় জানিয়ে শীতল রাত্রিতে বেরিয়ে পড়লাম। রাত ৮ টা খবরটা জুনিয়রের সাথে শেয়ার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওকে পেলাম না। পরে জেনেছিলাম, সে গিয়েছিল অরিগনের পোর্টল্যান্ডে এবং ঠাণ্ডায় হিল্টন হোটেলের পেছনে এক গলিতে মারা যায়। রাত ৯টা পকেটে আশি ডলার নিয়ে চলে এলাম সাউথ ডাউনটাউনের বিগ হার্টে। এটা একটা অল-ইন্ডিয়ান বার। কেউ ঠিক জানে না, কেন এবং কীভাবে ইন্ডিয়ানরা একটা বারকে অল-ইন্ডিয়ান বার বানিয়ে ফেলে। বিগ হার্ট তেইশ বছর ধরেই এরকম। আগে এটা ছিল অরোরা অ্যাভিনিউতে। কিন্তু এক উন্মাদ লুম্মি ইন্ডিয়ান সেটা পুড়িয়ে ফেলার পর বারটা এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। বিগ হার্ট-এ ঢুকে জনা পনেরো ইন্ডিয়ানের দেখা পেলাম। তাদের মধ্যে সাতজন মহিলা আর বাকিরা পুরুষ। এদের কাউকেই আমি চিনি না। কিন্তু ইন্ডিয়ানরা একে অন্যের নিকটজনের মতো। তাই আমরা ভান করি আমরা সবাই একে অন্যের কাজিন। “হুইস্কির জন্য কত লাগবে?” বারটেন্ডারের কাছে জানতে চাইলাম। “কোনটা চাও তুমি? জঘন্য নাকি জঘন্যের চেয়েও জঘন্যটা?” “যতখানি জঘন্যটা তোমার আছে।” “এক ডলার এক শটের জন্য।” বারের উপরে আশি ডলার রাখলাম। “হুম,” বললাম আমি,”আমি আর আমার কাজিনরা সবাই মিলে আশি শট গিলবো। একেকজনের ভাগে কয়টা পড়ে তাহলে?” “তোমাকে ধরে প্রত্যেকের জন্য পাঁচটা,” আমার পিছন থেকে এক মহিলা বলল। তার দিকে ঘুরে তাকালাম। গোলগাল ফ্যাকাসে ইন্ডিয়ান মহিলা। শুকনোমত লম্বা আরেক ইন্ডিয়ানের সাথে বসে আছে। “অল রাইট ম্যাথ জিনিয়াস,” তার উদ্দেশ্যে বললাম। এরপর চিৎকার করে বারের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম,”প্রত্যেকের জন্য পাঁচটা ড্রিঙ্কস আমার পক্ষ থেকে।” সব ইন্ডিয়ানরা বারের দিকে ছুটে গেলো। কিন্তু আমি ম্যাথমেটিশিয়ান আর তার শুকনোমতো বন্ধুর পাশে এসে বসলাম। ধীরে সুস্থে হুইস্কি গিলতে লাগলাম। “তুমি কোন গোত্রের?” জানতে চাইলাম। “আমি ডুওয়ামিশ,” জবাব দিল সে, “আর সে ক্রো।” “মন্টানা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছো দেখছি,” অন্যজনকে বললাম। “আমি একজন ক্রো(কাক)। আমি উড়ে উড়ে এখানে চলে এসেছি।” “তোমার নাম কী?”, জিজ্ঞেস করলাম। “আমি আইরিন মুজ,”মহিলা উত্তর দিল,”আর ও হানি বয়।” মহিলা আমার সাথে বেশ জোরের সাথে হ্যান্ডশেক করলো। কিন্তু পুরুষ মানুষটি এমনভাবে তার হাত বাড়িয়ে দিলো যেন আমি চুমু খেতে চাচ্ছি তাতে। অবশ্য তাই করলাম আমি। সে খিলখিল করে হাসতে লাগল এবং চোখ পিটপিট করে উঠলো। “তাহলে তুমি দুই-দিকেই…?” আমি জানতে চাইলাম। “মেয়েদের আমি পছন্দ করি। আবার ছেলেদেরকেও।” “কখনো একই সাথে দুইজনকেই,” আইরিন বলল। আমরা হাসাহাসি করতে লাগলাম। “সোনাপাখি,” হানি বয় বলল,”তুমি ঠিক যেভাবে চাও আমাকে সেভাবেই পেতে পারো।” “হে হে। হানি বয় প্রেমে পড়েছে,” আইরিন বলে উঠলো। “এর মধ্যে প্রেমে পড়ার কিছু নেই,” সে বললো। আমরা হাসতে থাকলাম। “ওয়াও! তুমি আমাকে মুগ্ধ করেছো, হানি বয়। কিন্তু বাপু আমি তোমার সাথে খেলবো না।” বললাম আমি। “অমনভাবে না বোলো না তো”, হানি বয় বলল। “তোমাকে সাবধান করে দিই,” আইরিন বলল,”হানি বয় কিন্তু জাদু জানে। তোমাকেও বশ করে ফেলবে।” “হানি বয়,” বললাম, ”চেষ্টা করতে পারো, কিন্তু আমার হৃদয় যে মেরি নামের এক মেয়েকে দিয়ে দিয়েছি আমি।” “তোমার মেরি কি এখনো ভার্জিন?” জানতে চাইল হানি বয়। হাসাহাসি চলতে থাকলো। হুইস্কি শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলতে লাগলো। অন্য ইন্ডিয়ানরা অবশ্য পরে আরও ড্রিঙ্কস অফার করলো আমাকে। এমনকি হানি বয় তার ক্রেডিট কার্ড বের করল আর আমি ড্রিঙ্ক করে গেলাম। এক ডজন পুরো হবার পর আইরিনকে নাচতে বললাম। সে রাজি হলো না। কিন্তু হানি বয় লাফ দিয়ে জিউকবক্সের দিকে চলে গেলো। একটা কোয়ার্টার ফেলে নতুন একটা গান বাজালো। উইলি নেলসনের “হেল্প মি মেইক ইট থ্রু দ্য নাইট”। আইরিন আর আমি টেবিলে বসে রইলাম। হাসাহাসি আর পাশাপাশি ড্রিংকিং চলতে লাগলো। হানি বয় ধীরে ধীরে ঘুরে নাচতে লাগল আর উইলি নেলসনের সাথে গলা মেলাতে লাগলো। “তুমি নিশ্চয়ই আমাকে উদ্দেশ্য করে গান গাইছো, তাই না?” ওকে জিজ্ঞেস করলাম। সে নাচতে নাচতে গাইতে থাকলো। “আমাকে উদ্দেশ্য করেই গান গাইছো, তাই না?”, আবারো জিজ্ঞেস করলাম। “সে তোমাকে জাদু করতে যাচ্ছে,” আইরিন বলল। আমি টেবিলের উপর শুয়ে পড়লাম। মুখ থেকে খানিকটা ড্রিঙ্ক ছিটকে পড়লো। তারপর আইরিনকে চুমু খেলাম। সেও পালটা চুমু খেল আমাকে। রাত ১০টা আইরিন আমাকে লেডিস বাথরুমে ঠেলে নিয়ে গেলো এবং দরজা আটকিয়ে দিল। এবং তার হাত প্রবেশ করল আমার প্যান্টের ভেতরে। সে আমার চাইতে খাটো। তাই তাকে চুমু খাওয়ার জন্য আমার নিচু হতে হল। তাকে ধরে আমি পাগলের মত পিষতে চাইলাম, শরীরের সব জায়গায়। কিন্তু সে অদ্ভুত রকমের মোটা এবং আমার হাত তার শরীরের যেখানেই পৌঁছল, সব জায়গাই মনে হল নরম, উষ্ণ স্তনের মতো। মাঝরাত নেশায় চুর হয়ে বারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। কসম খেয়ে বলতে পারি একটু আগেও আইরিনের সাথে বাথরুমে দাঁড়িয়ে ছিলাম। “আর এক গ্লাস দাও,” বারটেন্ডারকে বললাম। “তোমার কাছে আর টাকা নাই,” সে পালটা জবাব দিল। “কেউ আমাকে এক গ্লাস কিনে দাও,” আমি চিৎকার করে বললাম। “ওদের কারো কাছে টাকা নেই।” “আইরিন আর হানি বয় কোথায়?” “অনেক আগেই চলে গেছে।” রাত ২ টা “এখন বার বন্ধ হয়ে যাবে,” বসে থাকা তিন-চারজন ইন্ডিয়ানের উদ্দেশ্যে বলল বারটেন্ডার। “আইরিন আর হানি বয় কোথায়?” জানতে চাইলাম। “তারা অনেক আগেই চলে গেছে।” “কোথায় গেছে?” “একশবার বলেছি। আমি জানি না।” “এখন আমার কী করা উচিত?” “এখন বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে। তুমি কী করবে তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নাই। আপাতত এখান থেকে বের হয়ে গেলেই আমি খুশি হবো।” “অকৃতজ্ঞ বেজন্মা কোথাকার। তোর সাথে তো আমি খারাপ ব্যবহার করিনি।” “তুই যদি না বের হোস, তোর পাছায় লাথি মেরে বের করে দিব আমি।” “সাহস থাকলে আয়। বাপের নাম ভুলিয়ে দেব আজকে তোর।” সে আমার দিকে এগিয়ে এলো। তারপর কী হলো আমার আর মনে নেই। রাত ৪টা নিজেকে হাঁটতে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করলাম একটা বিশাল ওয়্যারহাউজের পিছনে। আমি জানি না আমি কোথায়। সারা মুখে ব্যথা। সম্ভবত নাক ভেঙ্গেছে। বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। শেষমেশ একটা ট্রাকের ভেতরে বিছানা থেকে প্ল্যাস্টিকের চাদর বের করে সেটা গায়ে পেঁচিয়ে মাটিতেই শুয়ে পড়লাম। ভোর ৬টা কেউ একজন আমার পাঁজরে গুঁতা মারলো। চোখ খুললাম এবং একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশকে দেখতে পেলাম। “জ্যাকসন না?” সে বললো। “অফিসার উইলিয়ামস,” আমি বললাম। সে একজন ভাল পুলিশ অফিসার। তার আচার-ব্যবহার ভালো। কত ক্যান্ডিবার যে সে আমাকে খাইয়েছে তার হিসেব নেই। সে বোধহয় জানেও না যে আমি ডায়াবেটিসের রোগী। “তুমি এখানে কী করছো?” সে জিজ্ঞেস করলো। “আমার শীত করছিলো আর ঘুম পাচ্ছিলো।তাই এখানে শুয়ে পড়লাম।” “বোকার হদ্দ কোথাকার। তুমি রেললাইনের উপর শুয়ে আছো।” আমি উঠে বসে চারদিকে তাকালাম। আসলেই আমি রেল লাইনের উপর শুয়ে ছিলাম। ডকে যারা কাজ করছিল তারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু এদিক-সেদিক হলেই রেলরোড ট্র্যাক পিজা হয়ে যেতাম। অসুস্থ লাগছিলো নিজেকে। হেলান দিয়ে বসে হুইস্কিটুকু বমি করে ফেললাম। “তোমার সমস্যা কী?” অফিসার জিজ্ঞেস করলো,”তুমি তো এমন আহাম্মকি করোনি আগে কখনো।” “আমার দাদী মারা গেছেন,” বললাম তাকে। “শুনে খারাপ লাগল। কখন মারা গেছেন?” “উনিশশো বাহাত্তর সালে।” “আর সেই দুঃখে তুমি এখন মরতে এসেছো?” “তার মৃত্যুর পর থেকেই আমি প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছি।” সে মাথা ঝাঁকালো। আমাকে দেখে তার খারাপ লাগছে। আগেই বলেছিলাম, লোকটা ভাল মানুষ। “তোমাকে কেউ একজন বেদম পিটিয়েছে,” সে বলল, ”কে এই কাজ করেছে বলো তো?” “মিঃ গ্রিফের সাথে লেগে গিয়েছিলো আমার।” “মিঃ গ্রিফ তোমাকে মেরে আস্ত রাখে নাই। ” “মিঃ গ্রিফ সবসময়ে জেতে আমার সাথে।” “হুম। চলো আমার সাথে।” সে আমাকে তার গাড়ীতে উঠতে সাহায্য করলো। আমাকে গাড়ির পেছনে বসালো। “বমি-টমি করলে কিন্তু তোমাকে পরিষ্কার করতে হবে,” সাবধান করে দিলো আমাকে। “ঠিক আছে।” সে হেঁটে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসলো। “আমি তোমাকে ডেটক্সে নিয়ে যাচ্ছি,” সে বললো। “প্লিজ। ওই জায়গাটা একটুও ভাল না। যতসব মাতাল ইন্ডিয়ান দিয়ে ভরা।” আমরা দুজনেই হাসলাম। সে ডকের দিকে গাড়ি চালিয়ে যেতে লাগলো। “আমি বুঝি না তোমরা কীভাবে পারো,” বলল সে। “কী পারি?” “এই যে তোমরা ইন্ডিয়ানরা। এতো হাসতে পারো তোমরা! আমি এইমাত্র তোমাকে রেল লাইনের উপর থেকে উঠিয়ে নিয়ে এলাম আর এখন তুমি কৌতুক করছো। কীভাবে পারো? ” “দুনিয়ায় সবচেয়ে মজার মানুষ হল ইহুদী আর ইন্ডিয়ানরা। আমাদের এত হিউমার আসে কোথা থেকে এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো।” আবার হাসলাম আমরা। “জ্যাকসন, তোমার কথা শুনেই বোঝা যায় তুমি অনেক স্মার্ট। তোমার মতো মানুষ রাস্তায় থাকে কেন?” “আমাকে এক হাজার ডলার দাও। আমি উত্তর দিচ্ছি।” “তুমি যদি টাকাটা ঠিক রাস্তায় ব্যবহার করবে জানতাম তাহলে সত্যি সত্যি-ই দিতাম।” সে মন থেকেই বলল কথাটা। মানুষটা আমার দেখা দ্বিতীয় সেরা পুলিশ অফিসার। “তুমি মানুষটা অনেক ভাল,” বললাম তাকে। “হয়েছে। আমার আমাকে ফুলাতে হবে না।” “না সত্যি বলছি। তোমাকে দেখলে আমার দাদার কথা মনে পড়ে।” “এমন কথা সব ইন্ডিয়ানরাই বলে আমাকে।” “সেটা নয়। আমার দাদা তার গোত্রের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে ছিলেন। তিনিও তোমার মতো ছিলেন। তিনি কখনো কাউকে এরেস্ট করেননি।তিনি সবাইকে দেখে-শুনে রাখতেন। ঠিক তোমার মতো।” “আমি কিন্তু শ’খানেক বদমাশকে এরেস্ট করেছি। কয়েকজনকে গুলিও করেছি।” “তাতে কিছু আসে যায় না। তুমি আর যাই হোক খুনী নও।” “আমি ওদের মারি না। শুধু পাকড়াও করি।” আমরা ডাউনটাউনে চলে এসেছি। ঘুমঘুম চোখে উদ্বাস্তু লোকজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধূসর আকাশটা দেখছে। জীবন্মৃত মানুষগুলোর আরেকটা দিন শুরু হলো। “তোমার ভয় করে না কখনো?” আমি বললাম। “বুঝলাম না।” “মানে এই যে পুলিশের দায়িত্ব পালন করাটা। তোমার ভয় হয় না কখনো?” সে একমূহুর্ত চিন্তা করলো। একদৃষ্টে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। এই ব্যাপারটা বেশ ভাল লাগে আমার। “আমি আসলে ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাই না। যত চিন্তা করবে, ভয় ততই তোমাকে জেঁকে ধরবে। আমার কাজটা বেশিরভাগ সময়ে অনেক ক্লান্তিকর। শুধু গাড়ি চালানো আর নজর রাখা সবদিকে এবং কিছুই ঘটতে না দেয়া। কিন্তু মাঝে মাঝে বিষয়টা অন্যরকম। তুমি কাউকে ধাওয়া করছো বা মারামারি করছো অথবা কোনো অন্ধকার বাড়ির চারপাশে ঘুরঘুর করছো, জানো এখানে কেউ ঘাপটি মেরে বসে আছে। এভাবে চিন্তা করলে আসলে ভয় লাগে।” “আমার দাদা দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই মারা পড়েছিলেন,” আমি বললাম। “শুনে খারাপ লাগলো। কিভাবে?” আমি জানি সে আমার গল্প মনোযোগ দিয়ে শুনবে। “তিনি রিজার্ভেশনে কাজ করতেন। সেখানে সবাই সবাইকে চিনতো। এটা নিরাপদ ছিলো। আমরা তো আর সাইওক্স বা এপাচিদের মতো যোদ্ধা ছিলাম না। গত একশ বছরে আমাদের গোত্রে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছিল মাত্র তিনটা।” “তার মানে তোমরা অনেক নিরাপদে ছিলে।” “হুম। আমরা স্পোকেইনরা কথা দিয়ে কথা রাখি। আমাদের মাঝে বড়জোর খোঁচাখুঁচি হতে পারে। কিন্তু আমরা কাউকে আঘাত করি না। কখনোই না। ” “তো তোমার দাদার কী হয়েছিলো?” “লিটল ফলসের কাছে এক লোক তার বান্ধবীর সাথে ঝগড়া করছিলো।” “হুম, ঘরোয়া ঝামেলা, খুব বাজে জিনিস।” “হুম। লোকটা ছিল আমার দাদার ভাই, আমার ছোটো দাদা।” “ওহ-হো।” “হুম। দাদা ধীরেসুস্থে ঘরে ঢুকেছিলেন। তিনি সেখানে অনেকবার গেছেন। আমার চাচা আর তার বান্ধবী মাতাল হয়ে রীতিমতো মারামারি করছিলো। তিনি তাদেরকে থামানোর চেষ্টা করলেন, যেমনটা আগেও করেছেন। তখন চাচার বান্ধবী কোনো কারণে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন বা ওইরকম কিছু। তার মাথায় ব্যথা লাগলো আর তিনি কাঁদতে লাগলেন। দাদা বসে তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন আর দেখলেন তার কোনো আঘাত লেগেছে কিনা। আর তখন-ই ছোটো দাদা কী এক কারণে খেপে গিয়ে দাদার হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে সোজা গুলি করলেন তার মাথায়।“ “ভয়াবহ ব্যাপার! শুনে খারাপ লাগলো।” “হুম। আমার চাচা নিজেও বলতে পারেন না কেন তিনি অমনটা করেছিলেন। তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিলো। তিনি জেল থেকে বিশাল বিশাল চিঠি লিখতেন। একেকটা চিঠি পঞ্চাশ-ষাট পৃষ্ঠার মতো হতো। তিনি লিখতে চাইতেন কেন তিনি অমনটা করলেন। এভাবে লিখেই গেছেন উনি। কিন্তু নিজে কখনোই জানাতে পারেননি গুলি করার কারণটা কী ছিলো। এ এক বিরাট রহস্য।” “তোমার কি দাদার কথা মনে আছে?” “অল্প-বিস্তর। তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে। আমার দাদী কিছুতেই তাকে কবর দিতে দিবেন না। শেষমেশ আমার বাবা তাকে জোর করে সরিয়ে নেন।” “বুঝতে পারছি না কি বলবো।” “আমিও না।” আমরা ডেটক্স সেন্টারে এসে থামলাম। “চলে এসেছি,” অফিসার উইলিয়ামস বললো। “আমার যেতে ইচ্ছা করে না ভেতরে।” “তোমাকে যেতেই হবে।” “প্লিজ। ওরা আমাকে চব্বিশ ঘণ্টা আটকে রাখবে। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে।” “কীসের দেরি হবে?” আমি তাকে আমার দাদীর রেগালিয়া আর কেনার সময়সীমার ব্যাপারটা বললাম। “এটা যদি চুরি হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তোমাকে রিপোর্ট করতে হবে,” সে বলল,” আমি নিজে তদন্ত করবো। যদি এটা সত্যি-ই তোমার দাদীর হয়ে থাকে, তাহলে আমি এটা আইনসঙ্গতভাবেই তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবো।” “না,” আমি বললাম,” সেটা তো ঠিক হবে না। ঐ দোকানমালিক তো আর জানতো না যে ওটা চুরি করা জিনিস। তাছাড়া এটা আমার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। জিতলে আমি হিরো হতে পারবো। আমি এটা যেভাবেই হোক, জিততে চাই।” “আহ কি রোমান্টিক অথচ উদ্ভট কথাবার্তা!” “হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টার মূল্য আছে। অনেকদিন এমনটা ঘটেনি আমার সাথে।” অফিসার উইলিয়াম তার গাড়ির সিটে গিয়ে বসল এবং আমার দিকে তাকালো। সে আমাকে পরীক্ষা করে দেখলো। “আমি তোমাকে কিছু টাকা দেই,” সে বলল,” আমার কাছে বেশি নেই। মাত্র ত্রিশ ডলারের মতো আছে। বেতন না পাওয়া পর্যন্ত আমার হাতে টাকা থাকবে না। জানি রেগালিয়াটা ফেরত পাবার জন্য এটা মোটেও যথেষ্ট না। কিন্তু এই সামান্য কটা টাকা বিশেষ কিছু।” “ঠিক আছে। আমি নিচ্ছি তোমার টাকা,” বললাম আমি। “তোমাকে টাকাটা দিচ্ছি কারণ তোমার বিশ্বাসে আমার আস্থা আছে। জানি না আমি কেন আশা করছি, তারপরও আশা করি তুমি কোনোভাবে এই ত্রিশ ডলারকেই এক হাজার ডলারে পরিণত করতে পারবে।” “আমি জাদুতে বিশ্বাস করি।” “আর আমি জানি যে তুমি এই টাকাটা মদের পেছনে উড়িয়ে দিবে।” “তাহলে আমাকে টাকা দিচ্ছো কেন?” “কারণ আমি বিশ্বাসী। পুলিশ কখনো অবিশ্বাসী বা নাস্তিক হতে পারে না।” “অবশ্যই পারে।” “ঠিক আছে। অন্তত আমি তাদের মধ্যে নই।” সে আমাকে গাড়ি থেকে নামালো। দুটো পাঁচ ডলার আর একটা বিশ ডলারের নোট হাতে তুলে দিলো। তারপর আমার হাত ধরলো। “নিজের প্রতি খেয়াল রেখো, জ্যাকসন। আর রেললাইন থেকে দূরে থেকো।” “চেষ্টা করবো।” সে চলে গেলো। টাকটা নিয়ে, আমি সমুদ্রের দিকে পা বাড়ালাম। সকাল ৮টা জাহাজ নোঙ্গর করার জায়গাটাতে এখনো অ্যালিউট ভাইয়েরা বসে আছে। “তোমাদের জাহাজ কি দেখা গেছে?” ওদের জিজ্ঞেস করলাম। “অনেক জাহাজ দেখা গেছে,” বড়জন বলল,” কিন্তু কোনোটাই আমাদের নয়।” আমি তাদের পাশে বসলাম। অনেকক্ষণ আমরা নীরবে বসে রইলাম। বসে থাকতে থাকতে মনে হলো, এভাবে একদিন ফসিল হয়ে যাব। দাদীর কথা মনে পড়লো। আমি কখনো তাকে রেগালিয়া গায়ে নাচতে দেখিনি। বড় ইচ্ছা ছিল, তাকে পোউওউ এর অনুষ্ঠানে নাচতে দেখার। “তোমরা কোনো গান জানো?” ওদের জিজ্ঞেস করলাম। “হ্যাঙ্ক উইলিয়ামসের সব গান আমার মুখস্থ,” বড়জন বলল। “কোনো ইন্ডিয়ান গান জানো?” “হ্যাঙ্ক উইলিয়ামস ইন্ডিয়ান।” “কোনো উপাসনামূলক গান?” “হ্যাঙ্ক উইলিয়ামসের চেয়ে বড় উপাসক আর নেই।” “আমি বলতে চাচ্ছি অনুষ্ঠানে গাওয়ার মতো গান। ধর্মীয় টাইপের কিছু। যখন তোমার নিজের বাড়িঘর ছিলো, ছিলো আশা আর ইচ্ছা।” “তোমার আশা আর ইচ্ছাটাই বা কী?” “আমি ভাবি যদি আমার দাদী আজ বেঁচে থাকতেন!” “আমি যত গান জানি তার সবগুলোই এই সব নিয়ে।” “ঠিক আছে। তাহলে যত গান জানো গাইতে থাকো।” অ্যালিউট ভাইয়েরা তাদের বিচিত্র গান অদ্ভুত সুন্দর সুরে গাইতে লাগলো। আমি শুনতে লাগলাম। তারা গাইল আমার দাদীকে নিয়ে। তাদের দাদীকে নিয়ে। ফেলে আসা শীত আর তুষারপাতের জন্য তাদের হাহাকার নিয়ে। আর আমার হাহাকার সবকিছুকে নিয়ে। সকাল ১০ টা অ্যালিউটদের শেষ গান শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও আমরা দীর্ঘসময় নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। এই একটা দিকে ইন্ডিয়ানরা ভাল। “ওটাই কি শেষ গান ছিলো?” জানতে চাইলাম। “যত গান জানি আমরা, সব-ই গেয়েছি। আর যে কটা বাকি আছে তা শুধু আমাদের জন্য।” বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা। আমরা ইন্ডিয়ানরা নিজেদের গোপনীয়তা বজায় রাখতে পছন্দ করি। অ্যালিউটরা নিজেদের গোপনীয়তা বজায় রাখতে এত উদগ্রীব যে তারা নিজেদের ইন্ডিয়ান পরিচয়টুকু পর্যন্ত গোপন রাখে। “তোমাদের কি ক্ষুধা লেগেছে?” জিজ্ঞেস করলাম। তারা নিজেদের মধ্যে নীরব ভাব বিনিময় করলো। “খেতে আপত্তি নেই।” বড়জন বলল। সকাল ১১টা অ্যালিউটদের সাথে খেতে গেলাম ইন্টারন্যাশনাল ডিসট্রিক্টের বিগ কিচেন-এ। আমি জানতাম, ওরা টাকা-পয়সা সাধলে উদ্বাস্তু ইন্ডিয়ানদের খাওয়াতে আপত্তি করবে না। “চারজনের জন্য সকালের নাস্তা দেবো?” আমরা ভেতরে ঢুকতেই ওয়েইট্রেস জানতে চাইলো। “হুম। আমাদের অনেক ক্ষিধে পেয়েছে।” সে আমাদের রান্নাঘরের কাছাকাছি একটা বুথে নিয়ে এলো। রান্নার খাবারে গন্ধ নাকে এলো। আমার পেটের ভেতর গুড়গুড় করে উঠলো। “চারজনের বিল কি আলাদা?” ওয়েট্রেস জিজ্ঞেস করলো। “উঁহু। আমি বিল দিচ্ছি,” আমি বললাম। “তুমি-ই কি আমার দেখা সবচাইতে উদার মনের মানুষ?” ওয়েট্রেস প্রশ্ন ছুঁড়লো। “এমন কোরো না,” আমি বললাম। “কেমন করবো না?” “এই যে এমন প্রশ্ন কোরো না যার উত্তর নেই। আমি এই ধরণের প্রশ্নগুলোকে ভয় পাই।” দেখে মনে হলো সে অবাক হয়েছে। তারপর-ই সে হাসতে শুরু করলো। “ঠিক আছে প্রফেসর। এর পর থেকে আমি তোমাকে সত্যিকারের প্রশ্নই করবো।” “ধন্যবাদ।” “তো তোমরা কী খেতে চাও?” “আহ, এর চেয়ে ভাল প্রশ্ন আর হয় না,” আমি বললাম,”তোমাদের এখানে কী কী আছে?” “তোমাদের মোট কত টাকা আছে?” “আরেকটা সুন্দর প্রশ্ন,” আমি বললাম, “আমার কাছে পঁচিশ ডলার আছে ব্যয় করার মতো। এই টাকায় যতখানি নাস্তা সম্ভব নিয়ে আসো। তাছাড়া তোমার বখশিশের টাকাও এর মধ্যে।” মেয়েটা হিসেব করে ফেলল। “ঠিক আছে। তাহলে চারটা স্পেশাল আর চারটা কফি। আর আমার বখশিশ পনেরো পার্সেন্ট।” আমরা চারজন নীরবে অপেক্ষা করলাম। খানিক বাদেই ওয়েট্রেস ফিরে এলো চারটা কফি নিয়ে। সেটা শেষ করার পরপর-ই সে আবার ফিরে এলো চার প্লেট নাস্তা নিয়ে। ডিম, বেকন, টোস্ট, আলু ভাজি। এতো অল্প টাকায় এতো খাবার হতে পারে এটা অবাক করা ব্যাপার। অনেক তৃপ্তি করে খেলাম আমরা। দুপুরবেলা অ্যালিউটদের বিদায় জানিয়ে সুদের কারবারের দোকানে চলে এলাম। পরে জেনেছিলাম, অ্যালিউটরা ৪৭ নাম্বার ডকের কাছাকাছি কোথাও নোনাপানিতে নেমে গিয়েছিলো। আর কখনো ফিরে আসেনি। কিছু ইন্ডিয়ান অবশ্য বলে তারা তাদের পানির উপর দিয়ে উত্তরের দিকে হেঁটে যেতে দেখেছে। অন্যরা বলে ওরা ডুবে গেছে। আমি জানি না আসলে কী ঘটেছে ওদের ভাগ্যে। আমি দোকানটা খোঁজার চেষ্টা করলাম কিন্তু পেলাম না। আমি নিশ্চিত এটা আগের জায়গায় নেই। দোকানটার খোঁজে আমি বিশ-ত্রিশ ব্লক হাঁটলাম । প্রত্যেকটা কর্নারে খুঁজে দেখলাম। এমনকি ফোন বুকেও নাম্বার খুঁজে দেখলাম। মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু দোকানটা মনে হয় কর্পূরের মতো উবে গেছে। মনে হল চিৎকার করে কাঁদি। ঠিক যখন আমি হাল ছেড়ে দিলাম, ঠিক তখন-ই ওটা চোখে পড়ল। এমন একটা জায়গায়, আমি কসম খেয়ে বলতে পারি মিনিটখানেক আগেও ওটা ওখানে ছিল না। আমি দোকানের ভিতরে ঢুকলাম আর মালিকের সাথে দেখা হলো। মালিককে আগের চেয়ে খানিকটা অল্পবয়স্ক মনে হল। “ফিরে এসেছো তাহলে,” সে বলল। “হুম, ফিরে এলাম।” “জ্যাকসন জ্যাকসন। ” “নাম মনে আছে দেখছি।” “তোমার বন্ধুরা কোথায়?” “তারা আমাকে রেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যাপার না। ইন্ডিয়ানরা সব জায়গাতেই আছে।” “টাকাটা জোগাড় হয়েছে?” “তোমার জানি কত টাকা লাগবে?” জিজ্ঞেস করলাম এই আশায় যে সে বোধ হয় এবার দামটা একটু কমিয়ে বলবে। “নয়শো নিরানব্বই ডলার।” দাম বদলায়নি। স্বাভাবিক। বদলাবেই বা কেন? “আমার অত টাকা নেই,” বললাম। “তোমার কত টাকা আছে?” “পাঁচ ডলার।” দুমড়ানো পাঁচ ডলারের নোটটা কাউন্টারের উপর রাখলাম। সে মনোযোগ দিয়ে দেখল এটা। “এটা কি সেই কালকের পাঁচ ডলারের নোটটাই?” “না। এটা আলাদা।” সে কি একটা ভাবল। “তুমি কি এই টাকাটা উপার্জন করতে পরিশ্রম করেছ?” “হ্যাঁ,” উত্তর দিলাম। সে চোখ বন্ধ করে অনেক কিছু চিন্তা করলো। তারপর সে পিছনের রুমে গেলো এবং দাদীর রেগালিয়াটা নিয়ে ফেরত এলো। “নাও এটা।” আমার দিকে বাড়িয়ে দিল ওটা। “আমার তো টাকা নেই।” “তোমার টাকা দিতে হবে না।” “কিন্তু আমি তো এটা টাকা দিয়েই জিতে নিতে চেয়েছিলাম।” “তুমি এটা জিতেই নিয়েছো। এখন আমার মত পাল্টানোর আগেই এটা নিয়ে ভাগো।” পৃথিবীতে ভাল মানুষ আছে কতজন? নিশ্চয়ই গুণে শেষ করা যাবে না! আমি দাদীর রেগালিয়াটা নিয়ে বাইরে হাঁটতে লাগলাম। আমি জানি, ঐ সোনালি গুটিটা আসলে আমার ভিতরেও আছে। কিংবা সেই খুঁতওয়ালা সোনালি গুটিটাই আসলে আমি। রেগালিয়াটা শরীরে জড়িয়ে আমার দাদীকে অনুভব করলাম। সেই অবস্থায় রাস্তায় হাঁটতে লাগলাম। পথচারীরা আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। গাড়িগুলো আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো। শহরটা আমাকে দেখে স্থবির হয়ে গেলো। তারা সবাই দেখলো আমাকে। আমি আমার দাদীর সাথে নাচছি। আমি-ই ছিলাম আমার দাদী। তিনি-ই নেচে যাচ্ছেন। মূল গল্প: What You Pawn I Will Redeem.