Wedding
এখনো বেঁচে আছি

মে, ২০২৩

এপ্রিল ২৫ তারিখ সন্ধ্যাবেলা আমি ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফিরছিলাম।

জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের মাঝে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। প্রফেসরের সাথে সম্পর্ক ধোঁয়াটে রূপ নিয়েছে। রিসার্চ এর কাজকর্মের উপর তীব্র বিতৃষ্ণা জন্মেছে। ভয়াবহ হতাশার মধ্যে দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। কাউন্সেলিং এর শরণাপন্ন হয়েছি কিন্তু কাজ হয়নি খুব একটা। মানুষের সাথে মেলামেশা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছি। বিভিন্ন গুজব রটেছে। একা বাসায় প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমে বেশিরভাগ সময় চুপচাপ দেয়ালের দিকে তাকিয়ে সময় পার করে দিয়েছি এসময়ে।

এপ্রিল এর ২৫ তারিখ দিনটি ছিলো মংগলবার। মাত্র তিনদিন আগে ছিলো ঈদ উল ফিতর। সেমিস্টার শেষের দিকে। ঈদের দিন সকাল পর্যন্ত একটানা কাজ করে অনেকগুলো কোর্স ডেডলাইন মিট করেছি। কাজের প্রেশার অবশ্যই কষ্টকর কিন্তু বিষন্নতা কিছুটা হলেও ভুলে থাকতে কাজে দেয় এটা। তো ঈদের দিনে সকালে নামাজ পড়ে এক বাসায় দাওয়াত খেয়ে দুপুরে আবার ক্লাসে গিয়েছি। ক্লাস শেষ করে কোর্স প্রফের ল্যাবে কাজ করে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেছি। রাতে ঈদ পটলাক এ গিয়েছি। সেখান থেকে রাতে এনামুলের বাসায় গিয়ে রাত জেগে মুভি দেখে বাসায় ফিরেছি। অতএব, শরীর আর চলছিলো না। পরের দুটো দিন ঘুমিয়ে পার হয়ে গেলো।

২৬ তারিখ একটা এসাইনমেন্ট ডেডলাইন। তেমন কিছুই করা হয়নি। আবার ২৫ তারিখে কোর্স প্রজেক্ট আপডেট দেখাতে হবে। ২৪ তারিখ অসময়ে ঘুমিয়ে ২৫ তারিখ অনেক ভোরে উঠে তাই কাজ শুরু করলাম।

এপ্রিল ২৫, ২০২৩। খুব সাধারণ একটা দিন। সকালে ফজর পড়ে মিটবল, spanakpita, ফিশবল দিয়ে নাস্তা সারলাম। এরপর এসাইনমেন্ট এর কাজ শুরু করলাম। আবার কিছুক্ষণ প্রজেক্টের কাজ। সকালে দীর্ঘ সময়ে কাজ করেও দেখা গেলো বেলা সাড়ে ১০ টা বাজে মাত্র। চুল অনেক বড় হয়ে গেছে। সময় পাওয়া গেছে তাই চুল কেটে আসলাম।

এর মাঝে অসময়ে একটা মিটিং পড়লো। জার্নাল এর ডেডলাইন সামনে। এই নিয়ে মিটিং। সকালের পর থেকে কিচ্ছু খাইনি । দুপুর এর পর থেকে হঠাৎ খুব খিচুড়ি আর ডিম ভাজি খেতে ইচ্ছা হলো। এদিকে সময় নেই বেশি, প্রজেক্টের কাজে ল্যাবে যেতে হবে। কাজেই ঠিক করলাম একবারে কাজ সেরে এসে রান্না করে খাবো। খিদেটাও জমবে আর খেতেও অসাধারণ লাগবে নিশ্চয়ই।

তখনো জানতাম না, ঐ রাতে আর ঘরে ফেরা হবে না আমার!

প্রজেক্টের কাজ সেরে প্রফেসরের সাথে কথা বলে বের হতে হতে প্রায় সাড়ে ৬ টা বেজে গেলো। স্প্রিং সেমিস্টারের শেষ ক্লাসটা শেষ হয়ে গেছে তাই ক্যাম্পাস মানুষ খুব কম। বাস ও নেই তেমন একটা। দীর্ঘক্ষণ বাসের জন্য অপেক্ষা করে আসর কাজা হয়ে যাচ্ছে দেখে অনেকটা হেঁটে reflection room এ গিয়ে নামাজ পড়ে আবার বাস স্ট্যান্ডে এসে বাসের অপেক্ষায় বসে থাকলাম।

ধীরে ধীরে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। মাগরিব হয়ে গেছে। বাসের দেখা নেই। একঘন্টা হয়ে গেছে। কোন মানে হয় এসবের! অতঃপর ঠিক করলাম আজকে veo e-scooter নিয়ে বাসায় যাবো। আবহাওয়া সুন্দর, বাতাস খেতে খেতে আরাম করে যাওয়া যাবে।

এই ছোট্ট সরল সিদ্ধান্তটির জন্য আমাকে কতকাল অনুতাপ করতে হবে জানি না!

veo নিয়ে বাসার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি। UF Rec center এর বিপরীতে ফুটপাথের উপর দিয়ে বেশ আস্তে আস্তে চালিয়ে যাচ্ছি। কাঁধের ব্যাগে ল্যাপটপ। আর ২-৩ মিনিট পর আমার স্কুটারের রেঞ্জ শেষ হবে। এরপর ৬-৭ মিনিট হাঁটলেই বাসা। বেশ ক্ষুধা লেগেছে। বাসায় গিয়ে রান্না বসাবো। নাহ মাগরিব পড়ে নিবো আগে। এসাইনমেন্ট নিয়ে রাতে বসবো। তার আগে একটু ঘুমিয়ে নিলে কেমন হয়?

সময় রাত সাড়ে আটটা। স্কুটারটার ডান হাতলের রাবার গ্রিপটা লুজ মনে হচ্ছে। খুলে আসলে তো ঝামেলা। আচ্ছা ব্যাপার নাহ, পৌঁছে গেছি প্রায়।

হঠাৎ গ্রিপটা মনে হলো খুলে আসলো। ফুটপাথের কোন একটা গ্যাপে স্কুটার এর চাকা পড়লো বোধহয়। আসলে ঠিক করে বলা মুশকিল কী হলো। আমি শুধু আবিষ্কার করলাম, কিচ্ছু বুঝে ওঠার আগে উড়ে গিয়ে ফুটপাথের উপর পড়ছি, হাত দিয়ে আটকানোর সময় পেলাম না। ভয়ানক গতিবেগে আমার থুতনি এবং চোয়াল আঘাত হানলো শক্ত কংক্রিটের উপর।

সাথে সাথে টের পেলাম কয়েকটা দাঁত ভেঙ্গে গেছে। সপ্তাহখানেক আগে ঠিক এরকম একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। এত স্পষ্ট স্বপ্ন ছিলো যে আতংকে ঘুম ভেংগে গিয়েছিলো। উঠে কয়েকবার দাঁত চেক করে দেখেছিলাম আসলে কিছু হয়েছে কিনা। কিন্তু সেই দুঃস্বপ্ন এই ঘটনার তুলনায় তেমন কিছু নয়।

নিচের ঠোঁট অবশ হয়ে এসেছে, গলগল করে রক্ত পড়ছে মুখের ভেতরেই। কুলি করে রক্ত ফেলতে হলো। চোয়ালের কোন একটা হাড় ভেংগে জিহবার নিচ থেকে উঠে এসেছে!

কোনমতে এই অবস্থাতে সাহায্যের জন্য ডাক দিলাম। আশেপাশের মানুষ ছুটে এলো, পেট্রল পুলিশ হবে এমন একটা অল্পবয়সী মেয়েকে দেখলাম একটু পর। আমার পাশে এসে শিউরে উঠলো। ওয়াকিটকিতে বললো, We’ve got a subject who’s got a serious injury in his jaw. Possibly multiple bone fractures. আশেপাশে জড়ো হওয়া মানুষের ফিসফিসানিও পরিষ্কার শুনতে পেলাম, Oh man, it doesn’t look good. It doesn’t look good at all!

আমার মাথায় তখন অজস্র চিন্তা ভিড় করেছে। কালকের এসাইনমেন্ট সাবমিশনের কী হবে? মে মাসের ১৫ তারিখ তো আমার ফান্ড শেষ হয়ে যাবে। তারপর কীভাবে চলবো? একটা OPS এর জন্য এপ্লাই করেছিলাম। তারা দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রেখে না করেছে ২ দিন আগে। মনটা বেশ খারাপ কদিন ধরে তাই। অনেক ক্ষুধা লেগেছে, খিচুড়ি খেতে ইচ্ছা করছে খুব। দেশে যাই না অনেকদিন হলো, মাকে জড়িয়ে ধরা হয় না। পিএইচডি করবো না আর, দেশে চলে যাই।

খুবই আশ্চর্য ব্যাপার, পুরোটা সময়ে আমার সম্পূর্ণ জ্ঞান ছিলো। আমি অসম্ভব সৌভাগ্যবান, কারণ এই ভয়ানক আঘাতটা আর কয়েক ইঞ্চি ওপরে মাথায় লাগলে আমি হয়তো এখন বেঁচে থাকতাম না। মাথায় আঘাত লেগেছে কিনা বোঝার জন্য ওরা আমাকে কিছু প্রশ্ন করলো আর আমি ঠিক ঠিক জবাব দিলাম। এখন ভাবতে অদ্ভূত লাগে, কিন্তু দ্রুত মাথার ভেতর দুবার দুটো সংখ্যা গুণ করে দেখলাম মাথা ঠিকমতো কাজ করছে কিনা।

দশ মিনিটের ভেতর এম্বুলেন্স চলে এলো। আমি নিজেই উঠে দাঁড়াতে পারলাম। মুখের অর্ধেকটা অবশ হয়ে এসেছে, ব্যথা টের পাচ্ছি না। কেবল মনে হচ্ছে, এমনটা হবার কথা ছিলো না, কিছুতেই না।

এম্বুলেন্সে করে যাচ্ছি আর অঝোর ধারায় কাঁদছি। পাশে বসে থাকা ছেলেটা বললো, সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করো না। কাঁদলে দেখবে কষ্ট কমে আসবে তোমার। আমি কাঁদতে কাঁদতে অমিতকে ফোন দিলাম।

হসপিটাল ইমার্জেন্সিতে পৌঁছানোর আগেই অনেক মানুষজন এসে হাজির। কিন্তু কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এর মাঝে আমার এক্স রে, সিটি স্ক্যান আরো নানান কিছু করা হলো। পরনের কাপড়চোপড় কেটে ফেলে দেওয়া হলো। ব্যথা যন্ত্রণা আর জীবনের প্রতি প্রচন্ড বেদনা নিয়ে কাঁদছি আমি। আমাকে এভাবেই স্ট্রেচারে শুইয়ে রেখে ডক্টর আর নার্সরা তাদের মতো কাজ করে বেড়াচ্ছে।

দীর্ঘসময়ে পর অবশেষে একজন ভিজিটরকে ঢুকতে দিলো ওরা। লিটন ভাই ছুটে আসলেন আমার কাছে। মমতা নিয়ে চোখের পানি মুছে দিলেন, টিস্যু দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করলেন। অমিত এলো একটু পর। মানসিক কষ্টের কাছে তখন শরীরের যন্ত্রণা ম্লান হয়ে গেছে। মাথা কাজ করছে সবই বুঝতে পারছি। মোবাইল নিয়ে মেসেজ দিলাম কয়েকজনকে, রিপ্লাই পড়লাম। অমিতকে বোধহয় বললাম মোবাইলের চার্জার নিয়ে আসতে।

এর মাঝে এক ফাঁকে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে এসে আমার চোয়াল ধরে কয়েকটা ইঞ্জেকশন দিয়ে দ্রুত সেলাই দিয়ে দিলো কয়েকটা। ফ্র্যাকচারের জন্য চোয়াল নিচে নেমে এসেছিলো অনেকটা, ওরা বোধহয় সেলাই দিয়ে কিছুটা উঠিয়ে ঝুলিয়ে দিলো।

সেই রাত! কী ভয়ংকর রাত! সময় চলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে এক দুজন এসে দেখে আবার চলে যাচ্ছে।

কী এক আশ্চর্য স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছেড়ে সাড়ে আট হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে হাজির হয়েছিলাম এই দেশে। ২৮ টি মাস পার করে অর্জন প্রায় শূন্য। রিসার্চ এ অন্ধগলিতে আটকে আছি, পাবলিকেশন হচ্ছে না, ভালো কাজ হচ্ছে না। আশেপাশের প্রায় প্রত্যেকটা মানুষ কী দুর্দান্ত কাজ করে যাচ্ছে! আমি কেবল একাই ব্যর্থতার সিল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। অন্যদিকে একাকীত্ব পেয়ে বসেছে প্রচন্ড আকারে এই সময়টাতে। সব ছেড়ে দিয়ে দেশে চলে যেতে ইচ্ছা করে।

এই দুর্ঘটনার পর জীবন নতুন এক তলানীতে গিয়ে ঠেকলো। এরপর কী হবে? সুস্থ হতে পারবো কী আদৌ? যন্ত্রণা কি শেষ হবে? যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলাম, সেই পিএইচডি কি কোন একদিন শেষ করতে পারবো?

নাকি ব্যর্থতার গ্লানির সাথে যোগ হওয়া শারীরিক অক্ষমতার কাছে হেরে গিয়ে হারিয়ে যাবো?

সারারাত চোখের পানি ঝড়িয়ে আবোলতাবোল বকে গেলাম।

মাঝরাতে কেবিনে ট্রান্সফার করলো আমাকে।

সকালে অনেক মানুষ চলে এলো দেখতে। এদিকে আমার প্রচন্ড ক্ষুধা পেটে। কিন্তু ডাক্তাররা বলছেন, একটা jaw adjustment surgery করতে হবে, এবং তার জন্য এনেস্থেশিয়া দেওয়া হবে। কাজেই খাওয়া যাবে না কিছু।

সকালে মনে হলো উঠে বসার মতো বা সামান্য হাঁটার মতো শক্তি অবশিষ্ট আছে এখনো। সবাই বললো যাও পারলে গোসল করে আসো। অতঃপর গোসলে ঢুকলাম এবং নিজেকে আয়নায় দেখতে পেলাম।

মুখ অদ্ভুত রকমের লম্বাটে এবং একপাশে সরে গেছে। রক্তে দাঁত পর্যন্ত লাল হয়ে গেছে। মুখের ভেতর জিহবার উপর এবং নিচে রক্ত জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে আছে। গোসল করে নিজেকে যতটা সম্ভব পরিষ্কার করলাম।

এদিকে জানা গেলো আমার সার্জারির শিডিউল পাওয়া নিয়ে ঝামেলা চলছে এবং একদিন পর শহরের আরেক প্রান্তে এক অপারেশন থিয়েটারে আমার শিডিউল ম্যানেজ হয়েছে। আবার হসপিটাল এর বিবেচনা অনুযায়ী আমি সিরিয়াস প্যাশেন্ট না কাজেই আমাকে রিলিজ করে দেওয়া হবে। অতঃপর অনেক বিবেচনা করে আমাকে তাশফিক এর বাসায় এনে রাখা হলো ঐ দিনটার জন্য।

দিনটা ২৬ এপ্রিল। আমেরিকা সময় দুপুর ২ টায় বাংলাদেশে ২৭ এপ্রিল রাত ১২ টা বাজে। আমি হাসপাতালে বসে ছোট ভাইকে জন্মদিন এর উইশ করলাম। আর রাতে ওকে জানালাম আমার এক্সিডেন্ট হয়েছে এবং পরদিন সার্জারি।

পরদিন প্রায় চার ঘন্টা ব্যাপী লম্বা সার্জারি হলো। সার্জারিতে ঢোকার আগে ছোটভাইকে জানিয়ে গেলাম। লিটন ভাইকে ওর নাম্বার দিলাম।

এনেস্থেশিয়া থেকে জ্ঞান ফিরলো প্রায় ছয় ঘন্টা পর। নাক পরিষ্কার করার জন্য টিস্যু চাইলাম। টিস্যু দিয়ে নাক ঝাড়তেই রক্তের ঝলক বেড়িয়ে এলো। জ্ঞান ফেরার পর আমার প্রথম স্মৃতি।

অতঃপর সবাই ধরাধরি করে গাড়িতে ওঠালো। লিটন ভাই বাসায় ফোন করে এক ঝলক দেখিয়ে দিলেন। ছোট ভাই নাকি প্রথমে কাউকে বলেনি। ঈদ এবং ওর জন্মদিন উপলক্ষ্যে বহুদিন পর কিছু মানুষকে দাওয়াত করে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিলো। ও তখন একা একা এক রুমে বসে হাউমাউ করে কাঁদছিলো।

এরপর এর ঘটনা সংক্ষেপ করা যাক। আমার নিজের বাসার পরিবেশ সুবিধার নয়। এক ব্ল্যাক রুমমেট একরকম অবৈধভাবে তার এক বন্ধুকে লিভিং রুমে উঠিয়ে রেখেছে দীর্ঘদিন ধরে। তার আবার বিশাল সাইজের এক কুকুর। কুকুর নিয়ে আমার সমস্যা নেই, কিন্তু কুকুর মানুষ দেখলে আদর পেতে চায়। হই চই করে গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অসুস্থ অবস্থায় এরকম কুকুর বাসায় বরদাস্ত করা যায় না। তার উপর এই রুমমেট এবং তার আড্ডা দিতে আসা বন্ধুরা লিভিংরুম ভয়ানক নোংরা করে রেখেছে। এর মাঝে এই উদ্বাস্ত ছেলেটি দিনরাত উচ্চস্বরে গান শুনে এবং গাঁজা খায়। এপার্ট্মেন্ট অফিসে অভিযোগ করলেই ওরা তল্পিতল্পা সহ ছেলেকে বিদায় করে দিবে কিন্তু মানবিক কারণে এই ঝামেলা করতে ইচ্ছা করে না। কাজেই সব দিক বিবেচনা করে আমাকে তৃণার বাসায় স্থানান্তর করা হলো।

কৃতজ্ঞতা সবার প্রতি। আমার জীবনের চরম দুঃসময়ে বন্ধু, শুভানুধ্যায়ীরা সবাই পালা করে দেখে গেছে, নিয়ম করে রাতে থেকেছে, ওষুধ খাওয়ার সময়ে ঘুম থেকে তুলে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে, খাবার রান্না করে এনেছে। পরিবার থেকে সাড়ে আট হাজার মাইল দূরে এরকম একটা পরিবার পাওয়া অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। আর শুধু তৃণার ব্যাপারে বলতে গেলে তো বই লিখতে হবে। নিশ্চয়ই লিখবো একদিন। লিখতে আমাকে হবেই!

কেমন আছি এখন? দাঁত এর যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। ঠিক না করা পর্যন্ত শক্ত খাবার খেতে পারবো না। তার উপর ভয়ানক ব্যথা। একটা দাঁতের ব্যথাই মানুষকে কাবু করতে যথেষ্ট। সেখানে আমার কতগুলো দাঁতের সমস্যা নিজেও জানি না। ডাক্তার বলেছেন, চোয়ালের ফ্র্যাকচার সারতেই ৩-৪ মাস লাগবে। এরপর নাহয় দাঁতের ট্রিট্মেন্ট করা যাবে। কাজেই এই যন্ত্রণা ততদিন সয়ে যেতে হবে যদি না নিজে থেকে ব্যথা না কমে।

ঠোঁট এর ডানপাশের অর্ধেকটা এবং তার নিচের থুতনির অর্ধেক অংশে এখন সেন্স ফেরেনি। নার্ভ ড্যামেজ হয়েছে সেখানে। ঠিক হতে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে।

সম্ভবত ব্যথার যন্ত্রণা থেকে বেশি কষ্টকর খাওয়ার কষ্ট। সব খাবার ব্লেন্ড করে নরম করে খেতে হয়। বিস্বাদ হয়ে যায় তখন খাবার। তৃণা অনেক চেষ্টা করছে খাবারে বৈচিত্র্য আনার কিন্তু কাজটা সহজ নয়।

দুর্ঘটনার পর আমার চিন্তাভাবনায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। পৃথিবীর সকল সমস্যা আসলে দুই প্রকারঃ প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট। এতকাল আমার সমস্ত সমস্যা ছিলো মানবসৃষ্ট। এখন এ জাতীয় সমস্যা খুব একটা গায়ে লাগছে না কেন যেন।

এখন ভাবি, বেঁচে থাকাটা সহজ নয়। তার জন্য কষ্ট করতেই হয়। যতটুকু কষ্ট করা প্রয়োজন করবো নাহয়। বেঁচে থাকলে অনেক কিছুই হবে।