এপ্রিল, ২০১৯ এক যুগ কিংবা তারও বেশি সময় আগেকার কথা। বসন্তের কোন এক বিকেলবেলা। মফস্বলের ছিমছাম সাজানো কোন এক এলাকা। জায়গাটার মাঝে ইতঃস্তত শহর ভাব জন্ম নিতে শুরু করেছে কেবল। গ্রাম-গ্রাম ভাবটা এখনো অনেক প্রকট এখানে। হুট করে গড়ে ওঠা দু-তিন
তলা কিছু বিল্ডিং, মাঝে মাঝেই টিনের চালের ঘর। খানিকটা জায়গা জুড়ে বাঁশঝাড়, একটু পরে পরে টলটলে পুকুর। বাঁশঝাড়ের সামনের তিনতলা বিল্ডিংটায় আমরা থাকি। পেছনে অনেকখানি জমি পরিত্যক্ত পড়ে আছে। জায়গাটা উঁচুনিচু খানাখন্দ আর ঝোপঝাড়ে ভর্তি। রাতের
বেলা সেখানে অতিপ্রাকৃত শব্দ শোনা যায় বলে জনশ্রুতি আছে। বিশেষ দরকার ছাড়া কেউ ওখানে যায়না। শীত চলে গেলেও তার ছায়া তখনো রয়ে গেছে। শেষরাতে হঠাৎ কাঁপুনি লাগে। বিকেলবেলা অফিসফেরত মানুষজন বারান্দায় বসে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দেখতে পায় দীর্ঘশ্বাসের
মতো শব্দ করে বাতাস বইছে। গাছের শুকনো পাতা সেই বাতাস উড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। আমরা ক’জন ছেলেমেয়ে হইচই করে বিকেলে খেলি। ব্যাডমিন্টনের মৌসুম শেষের দিকে, আগামী কয়দিন কি খেলা হবে সেটা নিয়ে একধরণের কনফিউশন চলছে সবার মাঝে। নানার রকম খেলার
ফিউশন করে একটা নতুন খেলা বানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলে মাঝে মাঝে। শেষে দেখা যায় সবাই উদ্দেশ্যহীন ভাবে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াচ্ছে। এটাই খেলা। অন্তু আমাদের প্রতিদিনের খেলার সংগী। আমার চেয়ে বয়সে সে অন্তঃত ৩ বছরের ছোট হবে। পড়াশুনা ব্যাপারটা আয়ত্ব করতে বিশেষ বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। চল্লিশ আর পঞ্চাশে কত হয় জিজ্ঞেস করলে বলে নব্বই, কিন্তু পঞ্চাশ আর চল্লিশে কত হয় জানতে চাইলে অনেক হিসেব করে বের করে উত্তর হবে একশ! তো একদিন উদ্দেশ্যহীন দৌড়াদৌড়ির মাঝখানে হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। আমি দাঁত কিড়মিড় করে ছুটে আসছিলাম, ঠিক কী কারণে মনে আসছে না, কিন্তু ওকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? নাহ। তেমন কিছু না। একটু মন খারাপ হয়ে গেছে আরকি। মন হুট করে খারাপ হয় কীভাবে? হয়। দেখিস না কীরকম মন খারাপ করা বাতাস বইছে। এই বাতাসে শুধু মন খারাপ হয়ে যায়। খেয়াল করে দেখি, ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। বাতাসে আবার মন খারাপ হয় কীভাবে? ভাবার সময় ছিল না। খেলার সময়ে এত ভাবতে নেই। সন্ধ্যার পর হাত-মুখ ধুয়ে এসে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মন খারাপ’ করা বাতাস কী জিনিস? মা বলল, বসন্ত আসলে ঝিরঝিরে একটা বাতাস আসে। পাতা ঝড়িয়ে নিয়ে যায়। যাদের মনে দুঃখ থাকে কিংবা অনেক সুখের আর আনন্দের স্মৃতি থাকে-তাদের এই বাতাসে মন
খারাপ হয়ে যায়। বলতে বলতে মা মন খারাপ করে ফেলে। আমি আর ঘাঁটাই না। মাস কয়েক পর অন্ত উধাও হয়ে গেল। ওর বাবা-মার ভীষণ ঝগড়া হতো আর বাবা মাকে মারতো। মার সহ্য করতে না পেরে একদিন অন্তুকে নিয়ে তার মা কোন অজানার পথে যেন চলে গেলেন। আর কখনো দেখিনি তাদের। বসন্ত আসে। পাতা ঝড়িয়ে যায়। আমি মন খারাপ করার সময় পাই না। সকালে স্কুলে যাই। হইচই করে সারাদিন পার করে বাসায় আসি। দুপুরে পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি করি। বিকেলে টিউটরের কাছে পড়ে খেলতে নামি। বিশাল হইচই হয়। কোনদিন বিকেলে বৃষ্টি হয়। জানালায় বসে
বৃষ্টি উপভোগ করি। চারদিকে এত এত সবুজ! জানালার পাশে বসে কোন একটা কিশোর উপন্যাস পড়তে পড়তে বৃষ্টি দেখি। নিচ থেকে উপরে তাকাই আস্তে আস্তে। নিচ হতে সবুজ থেকে ফিকে হতে হতে দিগন্তে বাদামী রঙের মেঘে গিয়ে মিলিয়ে যায়। দেখি আর পড়ি। সন্ধ্যার পর ইলেক্ট্রিসিটি থাকতো না কখনো কখনো। তখন ছাদে উঠে যেতাম। আকাশটা পরিষ্কার থাকলে অস্পষ্ট কিন্তু ধোঁয়ার মতো আকাশগংগা দেখা যেত। একবার মঙ্গল গ্রহটা পৃথিবীর অনেক কাছে চলে এল। আরো হাজার হাজার বছরেও নাকি এত কাছে আসবে না। প্রতিদিন সন্ধ্যার
পর ছাদে গিয়ে বসি। বিবর্ণ লাল রঙের একটা বিন্দু ঝুলে থাকতো আকাশে-ওইটা নাকি মঙ্গল। ঘন্টার পর ঘন্টা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি মুগ্ধ হয়ে। মাঝে মাঝে দুই-একটা তারা উল্কা হয়ে খসে পড়ে। দেখতে দেখতে কল্পনার চাদর বিছিয়ে দেই। রাত বাড়ে। ছাদের টবে
লাগানো গাছগুলোর পাতা মৃদুমন্দ বাতাসে তিরতির করে কাঁপতে থাকে। আকাশটা বিশাল এক গোলক হয়ে মাথার উপর ঘুরতে থাকে। ঘুরতে ঘুরতে এক বসন্ত পাড়ি দিয়ে আরেক বসন্ত চলে আসে। আবার চলে যায়। কখনো ফজরের আজান হলে বের হয়ে পড়তাম মসজিদের উদ্দেশ্যে। আকাশটা
ম্লান ফর্সা রূপ নিতো। নিচে সারা পৃথিবীর একভাগটা জুড়ে জমাটবাঁধা অন্ধকার তখনো। নামাজ শেষে বের হয়ে দেখতাম, অন্ধকার আলোয় রূপ নিয়েছে। আলো-আধাঁরির রূপ বদলের এই খেলা মনে হয় চিরকালই এক রহস্য হয়ে থাকবে আমার কাছে। ফিরতি পথে দেখতে পেতাম শিউলি ফুল রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। পুরো রাস্তা ধবধবে সাদা চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে যেন কেউ। পা দলতেই এই ফুল বিবর্ণ হয়ে যেত, রোদ উঠলেই যেত শুকিয়ে। খুব সুন্দর আর পবিত্র জিনিসগুলো কেন যেন বেশি সময় টিকে থাকে না। সেই শিউলি ফুল, সেই আকাশ, বৃষ্টি দেখার জানালা- সবই এখন অলীক স্বপ্ন মনে হয়। এখন আর আমার আকাশ জুড়ে নক্ষত্র আলো ছড়ায় না। ইট-পাথরের মরা শহরে বসন্ত আসে না।
*******
অফিস শেষ করে লেগুনায় ঝুলে বাসায় ফিরছিলাম। জ্যামে আটকা পড়ে আছি অনেকক্ষণ। সময় কাটাতে নেমে এসে রাস্তার পাশে দাড়ালাম। রাস্তার একপাশটা জুড়ে গাছের সারি চোখে পড়লো। ঝিরঝিরে বাতাস এসে গায়ে লাগলো। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে পেলাম মনে হল। প্রাণহীন
এই শহরে খুব মৃদুভাবে বসন্ত এসেছে। মুহূর্তের জন্য ফ্ল্যাশ ব্যাক করে চলে গেলাম বহু বহু দিন আগে। সেই বাঁশঝাড়, টলটলে পুকুর, শিউলি ফুল আর নক্ষত্রের রাতের দিনগুলোতে। আর কখনো কি ফিরে পাবো সেইসব? জ্যাম ছেড়েছে। লেগুনায় ঝুলে পড়তে হবে আবার। উৎকট গন্ধ আসছে কোথাও থেকে। পাগলের মতো হর্ন বাজিয়ে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। স্কাইস্ক্র্যাপারের আলোকসজ্জায় তারাভরা আকাশটাকে বড় ম্লান দেখায়। বসন্ত চলে যায় আগোচরে।
তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,
পৃথিবীর সব
গল্প একদিন ফুরাবে যখন,
মানুষ র'বে না আর, র'বে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখনঃ
সেই মুখ আর আমি র'বো সেই স্বপ্নের ভিতরে।
জীবনানন্দ দাশ