Hopi Point
ক্যানিয়ন দর্শন

জুলাই, ২০২৪

এই সামারের শুরুতে একদিন খুব শখ করে আমরা জনা চারেক মানুষ গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলাম ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশ্যে। ফ্লোরিডা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া যাবার হ্যাপা কম না, কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার মাইলের ড্রাইভ!

Grand Canyon National Park এ ঢুকছি যখন, পথে পথে চারদিন কেটে গেছে আমাদের! এর মাঝে এক হতচ্ছাড়া টেক্সাস পার হতেই দুদিন Gone!

আমাদের ক্যানিয়ন দর্শন শুরু হলো North Rim থেকে।

আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছি সেখান থেকে গভীর খাদ নেমে গেছে অন্তত তিন চার হাজার ফুট নিচে। সামনে মাইলের পর মাইল জুড়ে জায়গায় জায়গায় গিরিখাদ তৈরি হয়েছে, আর সে গিরিখাদ ভেদ করে চলে গেছে কলোরাডো নদী। লক্ষ লক্ষ বছর আগে পাহাড় ক্ষয়ে তৈরি মালভূমিকে ভূগভীর টেকটোনিক প্লেট ধাক্কা দিয়ে মাটির গভীর থেকে উঠিয়ে এনেছে। আর এর ভেতর চিড়ে দিয়ে চলে গেছে নদী, পেছনে রেখে গেছে গিরিখাদ।

বাদামী, লাল, সাদা ক্যানিয়নের গা জুড়ে অসংখ্য সমান্তরাল দাগ। এ দাগগুলো নাকি সেই লক্ষ বছরের ইতিহাস টাইম ক্যাপসুলের মতো ধরে রেখেছে।

আমরা ম্যাপ দেখে দেখে ট্যুরিস্ট বাসে ঘুরে ফিরে Mathers point আর Yavajwe point জায়গা দুটো ঘুরে আসলাম। ভর দুপুরের আকাশ এখন মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে। অস্বচ্ছ আলোতে মাইলের পর মাইল জুড়ে ছড়ানো নির্জন গিরিখাদগুলোর চেহারাও আলোর সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে।

বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। সেই সাথে হিম ঠান্ডা! আমরা চারটি প্রাণী দুটো ছাতা নিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আর হিম বাতাসের সাথে যুদ্ধ করতে করতে কাকভেজা হয়ে গেলাম। উপায়ান্তর না দেখে বাসে উঠে বসে রইলাম।

বাস আমাদের নিয়ে ঘুরতে লাগলো।

বৃষ্টি কমলো। আমরা আরো খানিকক্ষণ ঘুরেফিরে ক্যানিয়নের পুঁচকে একখানা মিউজিয়ামে কিছু সময় বিজ্ঞের মতো ক্যানিয়নের ত্রিমাত্রিক মডেল, মাটির স্যাম্পল নাড়াচাড়া করে দেখে হাত পা গরম করে আবার চলে এলাম গাড়ির ধারে।

খিদে লেগেছে।

আগের রাতের উচ্ছিষ্ট বাসী ও ঠান্ডা মুরগীর ভিন্দালু, কাপকেক আর ট্রেইল মিক্স মিশিয়ে এক অদ্ভূত লাঞ্চ সারলাম। নেহায়েত খাবার-দাবার নিয়ে আমার সাধাসিধে জিহবা আর পেট এর বাছবিচার নেই বলে পার পেয়ে গেলাম।

লাঞ্চ সেরে খানিক পথ গাড়ি করে আর অনেকটা পথ বাসে করে কিছুটা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমরা। জানা গেলো, Hopi Point নামে এক জায়গা আছে, সেখান থেকে সূর্যাস্ত দেখতে নাকি বড় মনোহর। এই মেঘলা দিনে আর সূর্যাস্ত দেখার মানে হয় নাকি? এ কথা ভাবতে ভাবতেই আমরা নেমে পড়লাম Hopi Point এ।

নামার পর যে দৃশ্য চোখে পড়লো সেটাকে পার্থিব বলা চলে না।

সারি সারি উপত্যকা। তার উপরে খানিক জায়গা জুড়ে মেঘ জড়ো হয়ে আছে। সেখান থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে হাজার হাজার ফিট গভীর গিরিখাদের ওপর। তার মাঝ দিয়ে সরু ফিতের মতো দেখতে রুপালী কলোরাডো নদীটা বয়ে যাচ্ছে।

বহুদূরে উপত্যকার পেছনে সূর্যটা হারিয়ে যাচ্ছে আস্তে ধীরে।

অপার্থিব ব্যাপারটা ঘটছে অন্য একটা জায়গায়।

মেঘের শরীর থেকে ধোঁয়ার মতো বৃষ্টি নামছে। একই সাথে শেষ বিকেলের নরম আলো মেঘ আর বৃষ্টির সাথে মিলেমিশে ছড়িয়ে পড়ছে।

মুহূর্তের জন্য মনে হলো, আলো চুইয়ে পড়ছে মেঘের শরীর থেকে! নাহ, আলো ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে মনে হলো আরেকবার।

খুব আলসে ভঙ্গিতে বৃষ্টির ফোঁটার গায়ে সওয়ার হয়ে নরম আলোর গুচ্ছ কেমন মায়া মায়া ভাবে উড়ে বেড়াচ্ছে।

যে মেঘ আর বৃষ্টির জন্য মন খারাপ হচ্ছিলো, ওদের যুগলবন্দী আজকে এই অপার্থিব বিভ্রম উপহার দিলো আমাদেরকে।

সূর্যটা হারিয়ে গেলো একসময়ে। তার আগে দিগন্তজুড়ে লাল, কমলা আর গাঢ় নীল রঙ এর ছাপ রেখে গেলো।

হাজার হাজার ফিট নিচের নদীটা এখন অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। ঐ গভীর উপত্যকা আর নদীর মাঝেও হয়তো প্রকৃতি ভিন্ন এক ব্যস্ত জীবন সাজিয়ে বসেছে। এত দূর থেকে ঝাপসা আলোয় সে ব্যস্ততা ধরা পড়ে না। আর ওই দুনিয়াটা দেখতে কেমন নিশ্চল লাগে এখান থেকে।

জগতের ভেতর আরেক জগত চলছে সেখানে তার নিয়মে, তার খবর আমাদের কাছে পৌঁছাবে না কোনদিন!

বাস চলে এসেছে। ফিরতে হবে এইবার। একদিনের ক্যানিয়ন দর্শনে মন মেটে না। আবারো ফিরবো কোন একদিন নাহয়!

আপাতত হোটেলে ফিরতে হবে। পরদিন Upper Antilope এ আলো-ছায়ার খেলা দেখবো, কলোরাডো নদীর পিছু তাড়া করে বিকেলবেলা Horse shoe bend দেখে আসবো। সেখান থেকে লাস ভেগাস যাওয়ার পথে কথা নাই বার্তা নাই আমাদের গাড়ির চাকা বিদঘুটে আওয়াজ করে জানান দিবে কোন এক সমস্যা হয়েছে গাড়িতে। সেই ঘোর রাত্রিবেলা মরুভূমি চিড়ে ঘুমন্ত শহরের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময়ে গাড়ির চাকা যেকোন সময়ে হুড়মুড় করে খুলে পড়তে পারে এমন এক আতংক নিয়ে শখানেক মাইল পাড়ি দিয়ে ভেগাস পৌঁছাবো আমরা।

সে গল্প নাহয় তোলা থাকুক অন্য আরেকদিনের জন্য।