Niagara Falls at night
কিপটা মিয়া

কাকরাইল, ঢাকা

মে, ২০২০

বুয়েটে থাকতে নানান কিসিমের মানুষজনের দেখা পেয়েছি।

এক ক্লাসমেট ছিলো, যার নাম ধরা যাকঃ কিপটা মিয়া! তার কিপটেমির নমুনা গল্প-উপন্যাসকেও হার মানাতো।

বিভিন্ন সময়ে তার করা অনেক কিপটেমি যেমন আমাদের হাসির খোড়াক জোগাতো, আবার কিছু কর্মকান্ড দেখে তার মানসিক সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ জাগতো।

কিপটা মিয়া আমার বেশ ভালো বন্ধু ছিলো, যদিও পরে বুঝতে পেরেছিঃ নিজের পড়াশোনা সংক্রান্ত কিছু স্বার্থ হাসিল যেমনঃ ল্যাব প্রজেক্টে করে দেওয়া, এটেন্ডেন্স দিয়ে দেওয়া- ইত্যাকার কাজের জন্যই বোধহয় সে বন্ধুত্ব রেখেছিলো।

পাস করার পরপরই সে মাস্টার্স করতে জার্মানি চলে গিয়েছিলো। আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখার প্রয়োজনিয়তাও তখন ফুরিয়ে গিয়েছিলো তার। ভদ্রতা করে যাবার আগে জানানোর দরকারও মনে করেনি সে।

জার্মানিতে গিয়েও সে কিছু ঘটনা ঘটিয়েছে বলে লোকমুখে শুনেছি, তবে সেগুলোর সূত্র অসমর্থিত এবং কিছু ঘটনা তার ব্যক্তিজীবনকেন্দ্রিক বলে আর সে প্রসঙ্গ এখানে টানলাম না।

নিচের গল্পগুলো সবই শতভাগ সত্যি! কোন এককালে এই পাপী চোখে বুয়েটে যা দেখেছি নামক গ্রুপে গল্পগুলো শেয়ার করে প্রচুর রিয়েকশন কামিয়েছিলাম!

পোস্ট ১

জনৈক ব্যাচমেটকে স্যার ক্লাস টেস্ট নিবেন তাই পেজ লাগবে বলে ডিপার্টমেন্ট অফিস থেকে পেজ নিয়ে তা দিয়ে পরবর্তীতে খাতা বানাইতে দেখেছি।

পোস্ট ২

ট্রিট দেওয়ার ভয়ে জনৈক কিপটা পাপীকে বিশ্বকাপে শেষ মুহূর্তে দল বদল করতে দেখেছি।

২০১৪ বিশ্বকাপ চলছে। কিপটা মিয়া জার্মানির পাড় সাপোর্টার। কিন্তু মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত আর জার্মানির দৌড় সেমিফাইনাল অব্দি। তাই পলাশীর মোড়ে একটা সমুচা খাওয়াতে যার বুক কাঁপে সেই কিপটা মিয়া নিশ্চিন্ত মনে ঘোষণা দিল, জার্মানি বিশ্বকাপ জিতলে সে ক্লাসমেট এবং উত্তরাগামী বাসের সকল যাত্রীকে ট্রিট দিবে। জার্মান বুলডোজার এক একটা দলকে গুঁড়িয়ে দিয়ে চলে যায় কিন্তু কিপটা মিয়া ঘাবড়ায় না। সে জানে তার প্রিয় দল তার বিশ্বাস(!) এর অমর্যাদা করবে না।

অতঃপর সেমিফাইনালে ব্রাজিলকে ৭ গোল খাইয়ে জার্মানি যখন আর্জেন্টিনার সাথে ফাইনালে উঠে গেলো তখন কিপটা মিয়ার মাথায় হাত! তবে কী জার্মানি জিতেই নিবে বিশ্বকাপটা ... নাহ এসব কথা মুখেই আনতে নেই!

বেচারা নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে নফল নামাজ পড়া শুরু করলো। হে আল্লাহ, ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে জিতায়ে দাও। পলাশীতে এরপর থেকে মাসে অন্তঃত পাঁচ টাকা(!) বরাদ্দ রাখবো ভিক্ষা দেওয়ার জন্য, তবুও তুমি আমাকে দেউলিয়া বানাইয়ো না। এনিমের জগতেও এমন বিট্রেয়াল দেখা যায় না!

শকুনের বদদোয়ায় গরু মরলো না। বন্ধুকে হতাশ করে জার্মানি বিশ্বকাপ জিতে নিলো।

তারপর? বহুদিন দেখেছি বাস ছাড়ার আগে কতিপয় মুশকো জোয়ান কিপটা মিয়াকে পাঁজাকোলা করে ক্যাফেতে তুলে নিয়ে গিয়ে বলতো, ট্রিট দে এইবার। কিন্তু সেই ট্রিট আজো কেউ পায়নি। সাধে তো আর তার নাম কিপটা মিয়া হয় নাই!

পোস্ট ৩

সিএনজি ভাড়া বাঁচাতে কিপটা বন্ধুর দৌড়ে গন্তব্যে যাওয়ার কথা শুনেছি!

২-২ এর কথা। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় মেকানিকাল কুইজ। সেদিন আবার সকাল দশটার মাঝে ক্লাস শেষ। আমাদের উত্তরা নিবাসী বন্ধু, ধরা যাক তার নাম কিপটা মিয়া, ক্লাস শেষ করে উত্তরা চলে গেলো টিউশনি করতে। সবাই যখন লাইব্রেরিতে বা হলে ফাইট দিতে ব্যস্ত, কিপটা মিয়া তখন একটার পর একটা টিউশনি করিয়ে যাচ্ছে। বিকালের দিকে সে উত্তরা থেকে বাসে বুয়েটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। সাড়ে পাঁচটার দিকে দেখা গেলো বাস প্রধানমন্ত্রীর অফিসের আগে জাহাংগীর গেটে এসে মরণ জ্যামে আটকা পড়ে আছে। কুইজ মিস যাওয়ার টেনশনে দিশেহারা বন্ধু এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখতে পেলো, রাস্তার উল্টোদিকে কয়েকটা সিএনজি দাঁড়ানো। বাস থেকে নেমে দামাদামি করলো সে। কেউই আড়াইশো তিনশোর নিচে যেতে চায় না। অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললো। যা হবার হবে আজকে। কিন্তু কষ্ট হলেও সে সিদ্ধান্ত পাল্টাবে না।

নাহ সে সিএনজি নেয়নি। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে দৌড় শুরু করে সোয়া এক ঘন্টায় বীরচিত্তে সে এসে পৌঁছেছিলো শাহবাগে। কিন্তু এর পরের অংশটুকু বলতে গিয়ে প্রতিবারই গলা ধরে আসতো তার।

শাহবাগে পৌঁছে তার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। তখন সে বাধ্য হয়ে বিশ টাকা, হ্যাঁ বিইইইশটা টাকা দিয়ে একটা রিকশা ভাড়া করে বুয়েটে আসার জন্য!

পরিশিষ্ট ১ঃ সাতটার দিকে আমরা তাকে ইএমই এর করিডোরে আবিষ্কার করি। সমস্ত শরীর লাল, ঘেমে অবসন্ন, তার মাঝে অপ্রকৃতস্থের মতো ইংরেজিতে চিৎকার করে একা একাই কথা বলছিলো সে। 😮 আমরা তাকে জোরাজুরি করে ওয়াশরুমে গিয়ে মাথায়, চোখে মুখে পানি দেওয়ার পর সে স্বাভাবিক হয়েছিলো।

পরিশিষ্ট ২ঃ সেই সেশনালে পরে এ প্লাস পেয়েছিলো সে। কিন্তু বিশ টাকা রিকশা ভাড়ার দুঃখে তাতে প্রলেপ লাগেনি। লোকাল বাসে নাকি এর চেয়ে কম ভাড়ায় উত্তরা যাওয়া যায়।

পরিশিষ্ট ৩ঃ কিপটা মিয়ার আরো অসংখ্য গল্প ছিলো ভান্ডারে। গ্রুপটা এত তাড়াতাড়ি আর্কাইভ না হলে হয়তো শেয়ার করা যেতো 🙁

পোস্ট ৪

লিজেন্ডারি কিপটা মিয়াকে নিয়ে কয়েকটা পোস্ট দিয়েছি। আরো কিছু কিপটা ফ্যাক্টস শেয়ার করা যাক।

১। কিপটা মিয়া মেগাবাইট বাঁচানোর জন্য পিসিতে ইমেজ ছাড়াই ব্রাউজার লোড করতো!

২। কিপটা মিয়া পুরো বুয়েট লাইফে দুই কি তিনদিন হলে রাত কাটিয়েছে। প্রতিবারই সকালে ক্লাস থাকলে ক্লাস করে দুই ঘন্টা + দুই ঘন্টা বাস জার্নি করে উত্তরায় বাসা থেকে লাঞ্চ করে রাতের খাবার সাথে করে নিয়ে আসতে দেখেছি তাকে। বাইরে দুই বেলা খাওয়ার চেয়ে চার ঘন্টা বাস জার্নি এবং ঘরের খাবার খাওয়া নাকি বেশি সাশ্রয়ী!

৩। ল্যাপটপের ব্যাটারি লাইফ যেন বেশিদিন থাকে সে কারণে সে ব্যাটারি ছাড়াই ডিরেক্ট এসি পাওয়ারে ল্যাপটপ চালাতো! থিসিস লেখার সময়ে হুট করে কারেন্ট চলে যাওয়ায় সেভ না করা ফাইল এভাবে হাওয়া হয়ে যেতে দেখেছি।

৪। কিপটা মিয়াকে প্রায়ই ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে এদিক সেদিকে যাইতে দেখতাম। পরে জানা গেলো, সে বিভিন্ন কম্পিউটার ল্যাবের মামাদের সাথে খাতির জমিয়ে ল্যাবগুলো যখন বন্ধ থাকতো তখন ঢুকে পিসিগুলাতে মুভি সিরিজ ডাউনলোড দিয়ে আসতো। ক্লাস শেষ হলে ডাউনলোডেড ফাইলগুলা পেনড্রাইভে কপি করে বাসায় চলে যেতো।

৫। শোনা যায়, জুনিওরদের র‍্যাগের ভয় দেখিয়ে সে নাকি বুয়েট বাসের টিকিট চাইতো! এভাবে এক বান্ডিল টিকিট দিয়ে সে বুয়েট লাইফ পার করে দিয়েছিলো বলে জনশ্রুতি আছে।

৬। কিপটা মিয়ার কাছে পানি চাইলেও সে পানি দেয় নাই এরকম ঘটনার সাক্ষী আছে বহু লোক।

৭। ল্যাব রিপোর্ট প্রিন্ট করতে হবে এবং টাকা খরচ হবে এই ভয়ে সে ল্যাব পার্টনার সব রিপোর্ট প্রিন্ট করবে এই শর্তে নিজের এবং পার্টনারের রিপোর্ট একাই লিখে দিতো! ল্যাব পার্টনারদেরকেও এহেন সংগী পেয়ে ব্যাপক আহলাদিত হতে দেখেছি।

৮। কিপটা মিয়া সেকশনের জার্সি ডিজাইন করে দিলে তার জার্সির দাম যাতে অন্যদের তুলনায় কম রাখা হয় সেজন্য রীতিমতো দরদাম করতে দেখেছি।

৯। বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে একবার স্টারে যাওয়ার পর শেষে খাবার অর্ডার না করে ব্যাগ থেকে পাথরের মতো শক্ত পোড়া রুটি বের করে খেতে দেখেছি তাকে। -_-

১০। বন্ধুবান্ধব এবং সি আর কখনো টাকা চেয়ে বসতে পারে বা ট্রিটের আবদার করতে পারে এই ভয়ে তাকে মোজার মধ্যে টাকা লুকিয়ে রেখে মানিব্যাগে মাত্র বিশ টাকার নোট নিয়ে ঘুরতে দেখেছি।

আপাতত এই কয়টাই মনে আসছে। পরে সময় করে আরো এড করা হবে।

(এখানেই পরিসমাপ্তি। আর কোন গল্প পরে আর এড করা হয়নি।)