জানুয়ারী, ২০২১ সে অনেকদিন আগের কথা। ক্লাস টেনে পড়তাম মনে হয়। যশোরে থাকি। একবার কী এক কারণে সপরিবারে ঝালকাঠীতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছি। ফিরবার সময়ে কোন বাসে যাবো তার খোঁজ-খবর চলছে এমন সময়ে এক ভদ্রলোক জানালেন, উনারা গাড়ি আছে, যাচ্ছেন যশোর। আমরা চাইলে লিফট দিতে পারি। এমন সুযোগ পেয়ে আমরা রাজি হয়ে গেলাম। সময়টা ঠিক মনে নেই, সম্ভবত এপ্রিল-মের কোন আগুনজ্বালা দিনের শেষে মন খারাপ করে দেওয়া বিষণ্ণ বাতাস বইতে থাকা বিকেলে আমরা বাবা, মা আর দুই ভাই গাড়িতে করে যশোরের উদেশ্যে রওনা দিলাম। সামনের দুই সিট বাদ দিলে সম্ভবত দুই রো মিলিয়ে ছয় সিটের গাড়ি। গ্রামের বাজার থেকে যাত্রা শুরু করে পাকা রাস্তা করে আমরা প্রথমে ঝালকাঠী তারপর বরিশাল শহরে ঢুকে পড়লাম। যাত্রাপথে সূর্য ডুবতে দেখলাম আর দেখলাম দুধের সরের মতো কেমন একটা মিহি আঁধারে চারপাশটা ঢেকে গেলো। জীবনে বহুবার বাসে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় আসা-যাওয়া করেছি, এমন দৃশ্য দেখেছি, কিন্ত ওইদিনের মতো এতটা খুঁটিয়ে দেখিনি কোনদিন। বিপত্তি শুরু হলো ঘন্টাখানেক পর। চিঁইই করে একটা শব্দ হলো আর গাড়িটা কেমন যেন খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছুটতে আরম্ভ করলো। একটু নিরিবিলি জায়গায় গাড়ি থামিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেলোঃ চাকা পাংচার। স্পেয়ার চাকা ছিলো সেটা লাগানো হলো। আধাঘন্টা পর আবারো চিঁইই শব্দ এবং গাড়ি খুঁড়িয়ে চলা শুরু করলো। এবার আর পরীক্ষা করতে হলো না, সবাই বুঝে গেলাম, স্পেয়ার চাকাটিও পাংচার! রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে পরীক্ষা করে ড্রাইভার এবং গাড়ির মালিক ভদ্রলোকও চাকা পরীক্ষা করে সেটাই বললেন। পরিস্থিতি বর্ণনা করা যাক। রাত আটটা বাজে। হাজার বছরের পুরনো সেই গ্রাম বলতেই আমাদের চোখে সবসময়ে জহির রায়হানের ডিফাইন করে দেওয়া একটা ছবি ভেসে উঠে। হাজার বছরের পুরনো শহর কথাটা কেমন বেখাপ্পা লাগে শুনতে তবে হাজার বছরের পুরনো গ্রামে যখন শহরের ছাপ পড়তে শুরু করে সেটাকে মোটা দাগে শহর না বলে আসলে মফস্বল বলে। তো আমরা এই মুহূর্তে ঘোর লাগা ঘুমের প্রস্তুতি শুরু করে দেওয়া যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছি সেটা মফস্বলের সব ছাপ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে সামনে। রাস্তার দুই পাশ খানিকটা নিচু, সেখানে কলাগাছের সারি, মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বেলে দেখতে পাচ্ছি টিন আর খড়ের ঘর, তার মাঝে পাকা কয়েকটা দু-তিনতলা বিল্ডিং ঢুকে গিয়ে শহর করে দেওয়ার প্রবল চেষ্টা করছে। দৃষ্টিসীমার মাঝে একটা বিশাল আলোর উৎস পড়েছে, ইতিউতি করে ঘাড় নেড়ে তাকিয়ে বুঝলাম, কাছাকাছি একটা পাওয়ার সাবস্টেশন রয়েছে, দূরের তীব্র আলোয় বড় কিছু টাওয়ার সদৃশ বস্তু চোখে পড়লো। এমন নির্জন জায়গায় এমন বিপদে পড়লে যে কেউ উৎকণ্ঠিত হবে কিন্তু আমি আর মা রাস্তার ধারে বসে পড়ে বেশ মুগ্ধ হয়েই দেখতে লাগলাম চারপাশ। ড্রাইভার আংকেল কী করেছিলেন আল্লাহই ভালো জানেন, তবে এই যাত্রা গাড়িতে ওঠার পর বুঝতে পারলাম পাংচার হওয়া চাকায় ভর করেই ছুটছে গাড়ি আর সময়ের সাথে বেড়ে চলেছে চাকার আর্তনাদ। দু'ঘন্টা চলার পর আর সহ্য করতে না পেরে গাড়ি থামানো হলো। এবারের জায়গাটা একেবারে গ্রাম। আলোর কোন উৎস নেই এখানে। নিশুতি রাত এখন, মানুষের সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না, রাতের বিচিত্র সব আওয়াজে থেকে থেকে চমকে উঠতে হয় কেবল। শহরে বড় হওয়া মানুষ আমি, রাতে আকাশের দিকে তাকানোর ফুসরত মেলেনা বা মিললেও সেখানে দেখার কিছু পাই না। আজ আকাশের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম! এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত জুড়ে বিস্তৃত তারার মেলা! তীব্র কালো আকাশের বুকে গেঁথে থাকা হাজার হাজার নক্ষত্রগুলো দেখতে দেখতে নেশা ধরে যায়। হুট করেই পুলিশের একটা টহল গাড়ি উদয় হলো কোথা থেকে। পরিস্থিতি শোনার পর তারা নিজেরাই কী একটা ব্যবস্থা করলেন যেন খেয়াল নেই, কিছু সময়ের জন্য একটা ভালো স্পেয়ার চাকা ম্যানেজ হলো। মাকে খুব বিষন্ন দেখা গেলো। নক্ষত্রের রাত ছেড়ে কে আজ ঘরে ফিরতে চায়! মাথার উপর অনন্ত নক্ষত্রবীথি রেখে পথ চলে ঘরে পৌঁছলাম রাত দু'টোর দিকে। অকারণে বিলম্ব না হলে এ যাত্রা আরো ঘন্টা চারেক আগেই শেষ হতো। কিন্তু এই স্মৃতিগুলো জমা হতো কী? জীবনের সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু আমার মনে হয় জীবন আসলে অসংখ্য স্মৃতির যোগফল হয়ে তৈরি হওয়া একটা এবস্ট্র্যাক্ট ব্যাপার। স্মৃতির কোন ছোট-বড় ব্যাপার নেই, ভালো স্মৃতি, মন্দ স্মৃতি, আনন্দের স্মৃতি, বেদনার স্মৃতি- সবটাই জীবনের দাঁড়িপাল্লায় একই ওজন দেয়। বয়স হলে আবার স্মৃতিরা প্রতারণা শুরু করে দেয়। তাই লিখে রাখি কিছু। কেউ না পড়ুক তাতে কী আসে যায়! আমি না থাকলেও লেখাগুলো চিহ্ন রেখে দিবে!
সমস্ত মৃত নক্ষত্রেরা কাল জেগে উঠেছিল-আকাশে এক তিল ফাঁক ছিল না;
পৃথিবীর সমস্ত ধূরসপ্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রের ভিতর দেখেছি আমি;
অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির-ভেজা চোখের মতো
ঝলমল করছিল সমস্ত নক্ষত্রেরা;
জোছনারাতে বেবিলনের রানির ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার
শালের মতো জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ!,
কাল এমন আশ্চর্য রাত ছিল।
জীবনানন্দ দাশ