নভেম্বর, ২০২০ এইতো কয়েকটা বছর আগের কথা। নভেম্বর আসতেই কিঞ্চিৎ বিরক্তি আর উত্তেজনায় বুক ঢিপঢিপ করতো। বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হতো সাধারণত মাসের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে। শীতটা জেঁকে বসতো ধীরে সুস্থে। দুপুরের রোদটা কড়া থেকে
কেমন যেন মিষ্টি আরামদায়ক উষ্ণতায় রূপ নিতো। বিকেলবেলা জানালার ধারে বিরক্তি সহকারে বই নিয়ে বসলেই চোখে পড়তো ধোঁয়ার মতো কুয়াশা নামছে গোবেচারা গাছগুলোর উপরে। পরীক্ষা শেষ হতো একটা একটা করে। শীতটা অনেক যন্ত্রণা করতো সেই সময়টাতে। সন্ধ্যাবেলা
গরম এক কাপ চা খেয়ে পড়তে বসে খানিক পর পরই চোখ চলে যেতো লেপের দিকে। ইচ্ছে করতো পড়াশুনা বাদ দিয়ে লেপ জড়িয়ে শুয়ে থাকি। অংক পরীক্ষার আগে অবশ্য সেটাই করতাম। হাস্যকর রকমের সহজ সব অংক দিয়ে ভরা গণিত বইটা হাতে নিয়ে লেপের নিচে ঢুকলেই চোখ ঘুমে
জড়িয়ে যেতো। পরীক্ষা শেষ হবার পর সে কী আনন্দ! সরকারি স্কুলে বছরের শুরুতে পড়াশোনার চাপ ছিলো না বলে ডিসেম্বর-জানুয়ারী অব্দি চলতো সেই আনন্দ। সকালে নাস্তা করে বাসা থেকে নামতেই দেখতাম বড় ভাইরা স্ট্যাম্প পুঁতছেন আর অন্য প্রান্ত থেকে
হাল আমলের ক্রেজ ব্রেট লী কিংবা মালিংগার স্টাইলে বল হাতে ছুটে আসছে কেউ। দুপুরে খেয়ে ঘন্টাখানেক পার হতেই আবার হাজির হতাম মাঠে। এবার ব্যাডমিন্টন। সবাই মিলে চাঁদা তুলে লাইট লাগাতাম। খেলা চলতো রাত এগারোটা-বারোটা পর্যন্ত। কখনো পাড়ার
সব ছেলেমেয়েরা মিলে চড়ুইভাতি করতাম। নিজেরাই একটা চুলা বসিয়ে একটুখানি খিচুড়ি, ডিম আর আলুভাজি রান্না করে খাওয়ার যে তৃপ্তি আর যে স্বাদ তার কাছে সবকিছু হার মানতে বাধ্য। গ্রামে ঘুরতে যেতাম প্রায়ই। ভয়ানক শীতে ভোরবেলা উঠে ফজরের নামাজ
পড়তে বের হতাম। ফিরতি পথে মায়াবী সাদা আলোয় হাজার বছরের পুরনো গ্রামটা বড় অচেনা ঠেকতো নিজের কাছে। সোয়েটারের উপর জ্যাকেট চাপিয়ে মাথা পেঁচিয়ে নিতাম মাফলারে, তবু শীত মানতো না। নিজের কানে নিজের দাঁত এর ঠকঠকানি শুনতে শুনতেই দেখতাম আরেকটা দিন
শুরু করার জন্য প্রকৃতি কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সূর্যটার সুমতি হলে কুয়াশা ঠেলেঠুলে সরিয়ে উঠে যেতো। আমরা দেখতাম গোঁয়ারের মতো গাছপালার শরীরে জমে থাকা কুয়াশা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। পুরোপুরি কেন যেন মিলিয়ে যেতো না, একটু দূরে গিয়ে পেছন
ফিরলেই মনে হতো আবার ওরা ফিরে এসে ঝাপসা করে দিতো সব। গাছের পাতায় টোকা দিলেই ঝপ করে সারারাত ধরে জমে থাকা পানি ঝরঝর করে ঝরে পড়তো। রাত নামতেই সব শুনসান হয়ে আসতো। কেন যেন ভয় করতো রাতের বেলা। ভূতের গল্পে ভূতেরা শীতের রাত্রেই বেশি বের
হয় কিনা তাই! তারপরও একটু অন্ধকার হতেই যখন স্ট্রিটলাইট গুলো জ্বলে উঠতো আর তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যেতাম, মনে হতো আলোর বৃত্তের বাইরে শত শত চোখ নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছে। বৃত্তের বাইরে চলে এলে সাহস করে পিছনে ফিরলে দেখতে পেতাম, ওপর থেকে কুয়াশা
পাউডারের মতো ছিটিয়ে দিচ্ছে কেউ। ভয়ে আর দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস হতো না। নভেম্বর থেকে জানুয়ারী। আমার কুয়াশা জড়ানো লেপের ওম মাখা দিনগুলি। উপদ্রবহীন নিশ্চিন্ত জীবনের দিনগুলি। ভয়জড়ানো নিষিদ্ধ সৌন্দর্য্যের হাতছানি মোড়ানো সময় আমার। কেন এই দিনগুলি আর আসে না? কেন প্রকৃতি আমাদের বড় করে দেয়? হায়রে জীবন আমার। একচিলতে ডিসেম্বরের বিকেল, দিনরাত একাকার করে খেলাধূলা আর চড়ুইভাতি করা, একটুখানি সোনামাখা রোদ্দুর আর অনেকখানি মিষ্টি কুয়াশা - এই সামান্য জিনিস ক'টা বুঝে উঠার
আগেই কেন হাতছাড়া হয়ে যায়?
একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে আর, জানি;
হৃদয়ের পথ-চলা শেষ হলো সেই দিন- গিয়েছে যে শান্ত হিম ঘরে,
অথবা সান্ত্বনা পেতে দেরি হবে কিছু কাল- পৃথিবীর এই মঠখানি
ভুলিতে বিলম্ব হবে কিছু দিন; এ মাঠের কয়েকটা শালিখের
তরে
আশ্চর্য বিস্ময়ে আমি চেয়ে র'বো কিছু কাল অন্ধকার বিছানার কোলে;
আর সে সোনালি চিল ডানা মেলে দূর থেকে আজো কি মাঠের কুয়াশায়
ভেসে আসে? সেই ন্যাড়া অশ্বত্থের পানে আজো চ'লে যায় সন্ধ্যা সোনার মতো হ'লে
ধানের নরম শিষে মেঠো ইঁদুরের
চোখ নক্ষত্রের দিকে আজো চায়
সন্ধ্যা হ'লে? মউমাছি চাক আজো বাঁধে না কি জামের নিবিড় ঘন ডালে,
মউ খাওয়া হ'য়ে গেলে আজো তারা উড়ে যায় কুয়াশায় সন্ধ্যার বাতাসে-
কতো দূরে যায়, আহা- অথবা হয়তো কেউ চালতার ঝরাপাতা জ্বালে
মধুর চাকের
নিচে- মাছিগুলো উড়ে যায়- ঝ'রে পড়ে- ম'রে থাকে ঘাসে
জীবনানন্দ দাশ